গণহত্যার পোস্টমর্টেম অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী নীল চোখ দুটো তার কালো কাপড়ে অবরুদ্ধ হলো। তারপর জীবন্ত পশুর মতো দড়ি দিয়ে বেঁধে, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো গণকবরের কাছে। কিছুক্ষন আগেও যে দেখেছিলো প্রেয়সীর রঙিন হাসি এলোকেশী চুল আর প্রেমের টান, নবজাতকের মায়াবী কান্না ভেজা চোখ কোমল আঙ্গুলগুলো ধরেছিলো বাবার শক্ত আঙ্গুল, অতৃপ্ত জীবন দেখেছিলো অনাগত স্বপ্ন কলমের খোঁচায় যার অক্ষরগুলো সাহিত্য হতো তাতে প্রতিবাদ ছিল প্রকৃতির আলো ছিল, নির্ঝরের স্বপ্ন ছিল, আর জীবনের জলছবি ছিল নানা রঙে বিজলি বাতির হিলিয়াম গ্যাসের মতো। আশা ছিল বৃদ্ধা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে মা মাগো আজও তোমায় ভালোবাসি যেমন বাসতাম ভূমিষ্ঠের পর থেকে যেভাবে একইভাবে, আর কেঁদোনা মা আমিতো আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমায় লাল বেনারসীতে সাজাবো বলে যা ছিল তোমার মনের কল্পিত কষ্টে, তুমি ভুলে গেলেও আমার চোখ তা দেখেছিলে নীরবে। ভেবেছিলো, বাবার পুরাতন ছেঁড়া জায়নামাজটার বদলে নুতন একটা মখমলের জায়নামাজ এনে দিবে, ফোকলা দাঁতে বাবার কষ্টের হাসিটা দেখবে আরেকবার যে মানুষটা লড়েছে আমাদের ভাতের জন্যে নিরন্তর নিঃশব্দে। কিন্তু মন্দ কপাল বেয়নেটের আঘাতে তারা থেতলে দিলো বুকের পাঁজর গুলো তারপর বের হয়ে এলো একটা নির্মম আর্তনাদ ঘোঙানির শব্দ বীভৎস হলো, বিবর্ণ হলো স্বপ্নের শ্রাবন। বুটের আঘাতে হাতের রগ গুলো ফেটে ফিনকি দিয়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত আলেক্সজান্ডারের ঘোড়ার গতির মতো গড়িয়ে পড়লো মাটিতে, নীরব হলো নিস্তব্ধ সহসাই। মুহূর্তেই প্রেয়সীর হাসিমুখ হয়ে গেলো বিধবার সাদা শাড়ি সন্তানের মায়াবী চোখ হয়ে গেলো এতিম, অনাথের নির্বাক দৃষ্টি, মা হারালো তার একমাত্র সন্তানকে আর বাবার কাঁধে সে দেখলো সন্তানের লাশ, খোদার আরশ কেঁপে উঠলো জল্লাদের নগ্ন ক্রীতদাসের উল্লাসে, থমকে দাঁড়ালো সময় পিরামিডের কংক্রিটের বস্তিতে মুহূর্তেই। সভ্যতা হারালো তার গতিপথ বাকরুদ্ধ হলো বাংলার মাটি আর টুকরো টুকরো স্মৃতি হলো কাফনের কাপড় মাটি ফেটে তৈরী হল কবর। তখনও বেঁচে ছিল, বেঁচে থাকার চেষ্টা ছিল আত্মাটা কন্ঠনালীর ভিতর দিয়ে ফুসফুসের ভিতরে আটকে রাখার লড়াই তখনও চলছিল যতক্ষণ স্বপ্নগুলো দৃশ্যমান ছিল ততক্ষন | পাষণ্ডরা আরো নির্মম হলো, শুকুনির মতো কামড়ে কামড়ে উদোম দেহ থেকে খুবলে খুবলে ধারালো দাঁতের বিষাক্ত ছোবলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলো নরম মাংস আর তা থেকে বেরিয়ে আসা বীরের নির্ভেজাল রক্ত। কসাইয়ের মতো শরীরের চামড়াগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখলো প্রাণহীন বৃক্ষের খণ্ডিত কাঠের মরচে ধরা প্রাচীন ইতিহাসে আর্য জাতির দেখা যেন মিললো চর্যাপদে। তারপর প্রাণের ভিতর থেকে ধুক ধুক করা আত্মাটা পাখি হলো, উড়ে গেলো না ফেরার দেশে, নির্জন নির্বাসনে আগুন হলো পবিত্র শরীর শহীদের লাশের পবিত্র গন্ধটা নোনাজল হয়ে গণকবর হলো। গণহত্যা হলো একজন দেশপ্রেমিক স্বামীর, একজন বিশ্বাসী বাবার, একজন সন্তানের আর একজন বীরঙ্গনা বোনের অভাগা ভাইয়ের যার হাতে তখনও ছিল নুতন বিয়ের মেহেদির রং আর ফাঁস টাঙানো মৃতদেহটা যেখানে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে তরল সাদা ফেনা জানোয়ারদের মুখুশটা খুলে ফেলবে বলবে অপলক খোলা চোখে। তারপর এলো স্বাধীনতা কিন্তু তারপরও পঁচাত্তরে গণহত্যা চালালো, বুলেটের নির্মম আঘাতে জোরালো রক্ত বিশ্বাসঘাতকের চোখ, নিমকহারামদের ষড়যন্ত্রের মসনদ পেলো। খুনিরা হলো রাজা, পরাজিত কাপুরুষের বংশধর ছিল ওরা আর বিপন্ন হলো মানবতা, লংঘিত হলো রাজপথের অগ্নিঝরা স্বপ্নের সোনার বাংলা শহীদের আত্মদান। বিধবার চোখ আজও অতৃপ্ত প্রেমের টানে কাঁদে পিতৃহীন সন্তানের আর বাবা বলা হয়ে উঠে না ও জানে বাবা বলে কেউ একজন ছিল কোনো একদিন, যার লাশটা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি ধ্বংস স্তুপের নামহীন বিকৃত গণকবরের মিছিলে আর যাবেনা হয়তো কোনোদিন। সন্তানের শোকে চোখের জল শুকিয়ে মা বাবা তারাও আজ আকাশের তারা হয়ে গেছে, যাদের জ্বল জ্বলে চোখে এখনও কষ্টের ঝড় উঠে, শোকের মাতমে উল্কা বৃষ্টির বজ্রপাত থমকে দাঁড়ায় বিচারের নিভৃত বাণী নীরবে কাঁদে। সময় বদলায় আবার আসে আলোকিত দিন স্বাধীনতা ঘুম ভেঙে জেগে উঠে শিকল ভেঙে কারাগার থেকে বের হয়ে আসে জনতার মঞ্চে। এবার বিচার হবে হতেই হবে কুন্ঠিত অবগুন্ঠিত লাজুক মন আগুনে পোড়ে শক্ত পাথর হয়ে বলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি খুনিদের বিচারের দাবিতে থাকবো অনন্তকাল যতদিন বাংলার মাটি আছে আমাদের অস্তিত্বে, কসম খোদার ভগবানের ওদের রক্ষে নেই আমার পবিত্র মাতৃভূমিতে। এরপর ………….উত্তরহীন অনিশ্চয়তা নাকি লক্ষের পথে পদযাত্রা ?