এই পৃষ্ঠা প্রিন্ট করুন
সোমবার, 24 আগষ্ট 2020 17:39

বৈষ্ণব কবিতা নির্বাচিত

লিখেছেন
লেখায় ভোট দিন
(0 টি ভোট)
                শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান!
    পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান,
    অভিসার, প্রেমলীলা, বিরহ-মিলন,
    বৃন্দাবনগাথা-- এই প্রণয়-স্বপন
    শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে,
    চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
    শরমে সম্ভ্রমে-- এ কি শুধু দেবতার!
    এ সংগীতরসধারা নহে মিটাবার
    দীন মর্তবাসী এই নরনারীদের
    প্রতিরজনীর আর প্রতিদিবসের
    তপ্ত প্রেমতৃষা?
               এ গীত-উৎসব-মাঝে
    শুধু তিনি আর ভক্ত নির্জনে বিরাজে;
    দাঁড়ায়ে বাহির-দ্বারে মোরা নরনারী
    উৎসুক শ্রবণ পাতি শুনি যদি তারি
    দুয়েকটি তান-- দূর হতে তাই শুনে
    তরুণ বসন্তে যদি নবীন ফাল্গুনে
    অন্তর পুলকি উঠে, শুনি সেই সুর
    সহসা দেখিতে পাই দ্বিগুণ মধুর
    আমাদের ধরা-- মধুময় হয়ে উঠে
    আমাদের বনচ্ছায়ে যে নদীটি ছুটে,
    মোদের কুটির-প্রান্তে যে-কদম্ব ফুটে
    বরষার দিনে-- সেই প্রেমাতুর তানে
    যদি ফিরে চেয়ে দেখি মোর পার্শ্ব-পানে
    ধরি মোর বাম বাহু রয়েছে দাঁড়ায়ে
    ধরার সঙ্গিনী মোর, হৃদয় বাড়ায়ে
    মোর দিকে, বহি নিজ মৌন ভালোবাসা,
    ওই গানে যদি বা সে পায় নিজ ভাষা,
    যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ প্রেমজ্যোতি--
    তোমার কি তাঁর, বন্ধু, তাহে কার ক্ষতি?
    সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
    কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
    কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
    বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান,
    রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?
    বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে
    কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
    আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
    রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা--
    রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
    চুরি করি লইয়াছ কার মুখ, কার
    আঁখি হতে! আজ তার নাহি অধিকার
    সে সংগীতে! তারি নারীহৃদয়-সঞ্চিত
    তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত
    চিরদিন!
                 আমাদেরি কুটির-কাননে
    ফুটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতা-চরণে,
    কেহ রাখে প্রিয়জন-তরে-- তাহে তাঁর
    নাহি অসন্তোষ। এই প্রেমগীতি হার
    গাঁথা হয় নরনারী-মিলনমেলায়,
    কেহ দেয় তাঁরে, কেহ বঁধুর গলায়।
    দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
    প্রিয়জনে-- প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই,
    তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
    দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।
    বৈষ্ণব কবির গাঁথা প্রেম-উপহার
    চলিয়াছে নিশিদিন কত ভারে ভার
    বৈকুণ্ঠের পথে। মধ্যপথে নরনারী
    অক্ষয় সে সুধারাশি করি কাড়াকাড়ি
    লইতেছে আপনার প্রিয়গৃহতরে
    যথাসাধ্য যে যাহার; যুগে যুগান্তরে
    চিরদিন পৃথিবীতে যুবকযুবতী--
    নরনারী এমনি চঞ্চল মতিগতি।
    দুই পক্ষে মিলে একেবারে আত্মহারা
    অবোধ অজ্ঞান। সৌন্দর্যের দস্যু তারা
    লুটেপুটে নিতে চায় সব। এত গীতি,
    এত ছন্দ, এত ভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি,
    এত মধুরতা দ্বারের সম্মুখ দিয়া
    বহে যায়-- তাই তারা পড়েছে আসিয়া
    সবে মিলি কলরবে সেই সুধাস্রোতে।
    সমুদ্রবাহিনী সেই প্রেমধারা হতে
    কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায় তীরে
    বিচার না করি কিছু, আপন কুটিরে
    আপনার তরে। তুমি মিছে ধর দোষ,
    সে সাধু পণ্ডিত, মিছে করিতেছ রোষ।
    যাঁর ধন তিনি ওই অপার সন্তোষে
    অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন বসে।
 
 
  ১৮ আষাঢ়  ১২৯৯     শাহাজাদপুর            
            
454 বার পড়া হয়েছে
শেয়ার করুন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত তিঁনি সৃষ্টিশীল ছিলেন। (উৎসঃ উইকিপিডিয়া)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সর্বশেষ লেখা