এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!- আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া, যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি, ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ! এত ভালো তুমি? এত ভালোবাসা? এত তুমি মহীয়ান্? ভগবান! ভগবান! তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ, পিতা! সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তবু জননীর মতো ভীতা! নাহি সোয়াসি-, নাহি যেন সুখ, ভেঙে গড়ো, গড়ে ভাঙো, উৎসুক! আকাশ মুড়েছ মরকতে-পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান। তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ! ভগবান! ভগবান! রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে- ‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে। এই ধরণীর যাহা সম্বল,- বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল, সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,- সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’ ভগবান! ভগবান! শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ। আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ! তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে, সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান। সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান! ভগবান! ভগবান! তব কনিষ্ঠ মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধুলা-মাটি, তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি! ময়ূরের মতো কলাপ মেলিয়া তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া- সন্তান তার সুখী নয়, তারা লোভী, তারা শয়তান! ঈর্ষায় মাতি’ করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান! ভগবান! ভগবান! তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী, রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী! মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া! সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস’ান! ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান! ভগবান! ভগবান! জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়, সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়। মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ, মাটির মালিক তাঁহারাই হন- যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান। নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান। ভগবান! ভগবান! অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি, সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি! তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ! এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান্ । পীড়িত মানব পারে না ক’ আর, সবে না এ অপমান- ভগবান! ভগবান! ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহি ক’ আর! ‘ মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার!’ রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ, নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ! শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান- ‘ জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান! জয় জয় ভগবান!’ তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে কবির ভোগ, এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ। তাজা ফুল ফলে অঞ্চলি পুরে বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে, কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান? আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ- এতদিনে ভগবান! যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা, সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা? উদার আকাশ বাতাস কাহারা করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা? তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান? হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান? ভগবান! ভগবান! তোমার দত্ত হসে-রে বাঁধে কোন্ নিপীড়ন-চেড়ী? আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী? ক্ষুধা তৃষা আছে, আছে মোর প্রাণ, আমিও মানুষ, আমিও মহান্ ! আমার অধীনে এ মোর রসনা, এই খাড়া গর্দান! মনের শিকল ছিঁড়েছি, পড়েছে হাতের শিকলে টান- এতদিনে ভগবান! চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উ”চ শির। বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর। এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো- আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো, এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ। মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান- জয় নিপীড়িত প্রাণ! জয় নব অভিযান! জয় নব উত্থান!
কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৪, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (উৎসঃ উইকিপিডিয়া)
কাজী নজরুল ইসলাম এর সর্বশেষ লেখা
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.