বৃহষ্পতিবার, 12 অক্টোবর 2017 22:54

ভাবনার গল্প নির্বাচিত

লিখেছেন
লেখায় ভোট দিন
(0 টি ভোট)
                ভাবনার গল্প

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
১
অনেকদিন আগের কথা। কয়েকজন মানুষ আদালত পাড়ার সামনে টাইপ রাইটার নিয়ে বসতো। প্রচুর কাজ তারা সারাদিন ধরে করতো। আয় উপার্জনও বেশ ভালো ছিল। সুখেই তাদের সংসার চলছিল। কিন্তু বিজ্ঞান  ও প্রযুক্তি তো থেমে থাকেনা। এটা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ধারায় এলো কম্পিউটার। লোকজন কম্পিউটারের প্রতি  ঝুকে পড়লো। যারা টাইপ রাইটার নিয়ে বসেছিল, তাদের কাছে আর কেউ যেতোনা | তাদের দুর্দিন দেখা দিলো | এদের মধ্যে কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলো তারা নিজেদের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত করে নিবে | তারা পরিবর্তনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলো | এরপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে  কম্পিউটার শিখার উদ্যোগ গ্রহণ করলো | তারা খুব দ্রুত তাদের নিজেদের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে  নিলো এবং তাদের আয় উপার্জন আগের থেকে অনেক বেড়ে গেলো | তারা নিজেরা সমৃদ্ধ হলো আর সংসারে আগের চেয়ে সমৃদ্ধি নিয়ে এলো | কিন্তু তাদের মধ্যে বাকি যারা ছিল তারা পরিবর্তনকে বোঝা হিসেবে মনে করলো | তারা নিজেদেরকে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে ভয় ও অনাগ্রহ প্রকাশ করলো | তারা দিন মজুর হিসেবে কাজ করা শুরু করলো | কোনোদিন কাজ পেতো আর কোনোদিন পেতোনা | তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লো আর সংসারে অশান্তি নেমে এলো  | সময় বদলায়, তার সাথে আসে প্রযুক্তির পরিবর্তন | যারা সেই পরিবর্তনের সাথে চলতে পারেনা তারা থেমে যায় আর যারা চলতে পারে তারা এগিয়ে যায় | আর এটাই বাস্তবতা |
২
কবি বলেছিলেন “কত রূপ স্নেহ করি দেশীয় কুকুর ধরি বিদেশি ঠাকুর ফেলিয়া ” আর জীবনানন্দ বলেছিলেন “আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়. হয়তো বা মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,. হয়তো বা ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে, কুয়াশার বুক ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়।” এরকম একটি গল্পের কথা বলছি | ফরহাদ ও মাজহার দুজনেই একইসঙ্গে দেশের একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলো | দুজনেই তাদের শিক্ষা, গবেষণা ও ছাত্রদের প্রতি অবদানের মাধ্যমে খুব দ্রুত সবার কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পেলো | সবাই তাদের অর্জনে খুশি হলো | তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় গমন করলো | সেখান থেকে দুজনেই পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করলো | এদের মধ্যে ফরহাদ  দেশের টানে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার  সিদ্ধান্ত নিলো | তার মধ্যে আরেকটি বিষয় কাজ করছিলো তা হলো যে দেশ তাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে  তার প্রতি তার একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে | সে তার বিবেক দ্বারা  তাড়িত হয়ে বিষয়টি অনুভব করলো | দেশ ও দেশের মানুষকে সেবার মহান ব্রত নিয়ে সে দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলো | একদিন সে কালক্রমে অধ্যাপক হলো | দেশ তার দ্বারা উপকৃত হলো, দেশের গন্ডি পেরিয়ে তার সুখ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়লো  | তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সে একদিন জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত হলো | মাজহারের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত | সে দেশের চেয়ে বিদেশকে বেশি প্রাধান্য  দিলো | সে বলে বেড়াতে লাগলো “দেশ আমাকে কি দিলো সেটি বড় কথা নয়, আমি দেশকে কি দিলাম সেটি বড়কথা” এটা সে বিশ্বাস করেনা |   সে আরো বলতে লাগলো “দেশের কোনো ভবিষৎ নেই | ওখানে গিয়ে কি হবে আমার নিজের স্বার্থটা আগে দেখতে হবে, দেশের আবার স্বার্থ কি  |”  সে তার মাতৃভূমিকে অবজ্ঞা করলো |  কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আর কঠিন |  আমেরিকায় প্রথমে সে যার তত্বাবধানে পিএইচডি করেছিল তার একটি দুই বছরের প্রজেক্টে চাকুরী নিলো | প্রজেক্ট শেষ হলে তাকে বলা হলো আজ থেকে তোমার চাকুরী নেই | এরপর মহা বিপদ তার জীবনে নেমে আসলো | সে দ্বারে  দ্বারে ঘুরে কোনো চাকুরী পেলোনা |  তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে সে  কোনোমতে একটা ট্যাক্সি চালানোর চাকুরী পেলো | সবসময় মার্কিন সরকারের নজরদারির মধ্যে তাকে থাকতে হলো | এতো বড় ডিগ্রী পেয়ে সে  মার্কিন সরকারের সন্দেহের মধ্যে পরে গেলো আর সে এখন একজন গাড়ির ড্রাইভার | সে হতাশাগ্রস্ত হলো  | সে যে নিজের দেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল সেখানে আবার যোগদান করার আকুতি জানালো | কিন্তু সময় খুব নির্মম যেমন সে একসময় নির্মম ছিল তার দেশের প্রতি আনুগত্যে   | একদিন হতাশায় ভূগতে ভূগতে ব্রেন স্ট্রোক  করে সে কম বয়সে মারা গেলো |  হয়তো এটাই ছিল প্রকৃতির বিচার | তবে এর ভিন্নতাও  ঘটতে  পারে তবে সেটা হাতেগোনা | এ. পি. জে. আবদুল কালাম আজাদ এমন একজন প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন তাকে কিন্তু আমেরিকার মতো দেশ কিনতে পারেনি | এর কারণ ছিল তার দেশপ্রেম |  ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয় | তিনি ভারতের সফল রাষ্ট্রপতি ছিলেন |   এ. পি. জে. আবদুল কালাম আজাদ বলেছিলেন “তিনজনই পারেন একটি দেশ বা জাতিকে বদলাতে। তাঁরা হলেন, বাবা, মা ও শিক্ষক।” আমরা শিক্ষকরা  কি তা পারছি নাকি দেশের স্বার্থের চেয়ে আমরা ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিদেশ বিভুয়ে পরদেশী পরজীবী হয়ে দিন যাপন করছি |  কেননা তিনি বলেছিলেন “যদি সূর্য হতে চাও তবে সূর্যের মতো নিজেকে পোড়াও।” আমরা দেশে থেকে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে একদিন সোনা হতে চাই |
৩
দুজন মানুষ ছিলেন | তারা দুজনেই বাংলাদেশে বাস করতেন | এদের একজন দেশীয় সংস্কৃতির  চর্চা করতো আর একজন এগুলো অবজ্ঞা করতো | একদিন সকাল বেলা দুজন দুজনের সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছে | সন্তানরা তাদের বাবাদের জিজ্ঞাসা করলো “কেন আজ সবাই  বাসন্তী রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলেছে ।” যে বাবা  দেশীয় সংস্কৃতির  চর্চা করতো সে তার সন্তানকে বললো “আজ বসন্ত উৎসব, বসন্তের প্রথম দিন | তাই মনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে সবাই নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে | তিনি গুন্ গুন্ করে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের সেই পরিচিত গান ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়….।’ তিনি উচ্চারণ করলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমীয় বাণীটি   ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত’ | ছেলেটি তার  সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে গর্ববোধ করলো | তার নিজের ঐতিহ্যে  সে আনন্দিত হয়ে   উঠলো | আর যে বাবাটি  দেশীয় সংস্কৃতির  চর্চা করতোনা সে  তার কোনো সদুত্তর দিতে পারলোনা | সে বললো মনে হয় এরা সবাই নৃত্য শিল্পী   কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছে  অথবা এরা  বিয়ের অনুষ্ঠানে  গমন করছে |  তার ছেলেটি সংকীর্ন ও ভুল একটা জিনিস সারাজীবন নিজের মধ্যে ধারণ করে নিলো |
এখানে শিক্ষণীয় বিষয় গুলো হলো
১ | প্রযুক্তির সাথে যারা চলতে পারে তারাই টিকে থাকে আর যারা চলতে পারেনা তারা থেমে যায়|
২| দেশকে ভালোবাসুন আর দেশপ্রেমিক হতে শিখুন | স্বার্থপরতা ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে কাজ করুন |
৩| নিজের সংস্কৃতিকে  চিনুন ও মনের উদারতা তৈরী করুন |            
            
652 বার পড়া হয়েছে
শেয়ার করুন
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর এ দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি যেমন অবদান রেখে চলেছেন তেমনি সৃষ্টিশীল লেখার ক্ষেত্রেও তাঁর পদচারণা। তিনি মনে করেন বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অন্যের পরিপূরক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার, নাট্যকার, সমাজ সংস্কারক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনে বিশ্বাসী এই মানুষটির ছোটবেলা থেকেই লেখায় হাতেখড়ি। কৈশোর ও তারুণ্যে তিনি বাংলা একাডেমি, খেলাঘর, কঁচিকাচার মেলা সহ বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেছেন। এই সময় তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যায়নের সময় তিনি প্রগতিশীল কর্মী হিসেবে কাজ করে সহিত চর্চা করে গেছেন। এ সময় তাঁর লেখাগুলো বিশ্ববিদালয়ের ম্যাগাজিনে এখনও সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও অনেকদিন ধরেই তিনি দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই সাহিত্যেই তাঁর সমান দক্ষতা রয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, পরিবর্তন, সম্ভাবনা ও মানুষ তাঁর লেখার মূল উপজীব্য বিষয়। তিনি একজন ভাল বক্তা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক্ শো সহ বিভিন্ন সৃজনশীল অনুষ্ঠানে তাকে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। ভারতরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী অজিত কুমার পাঁজা কলকাতা দূরদর্শনের একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রেরিত প্রবন্ধে মোহিত হয়ে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সে সময় সম্প্রচারিত হয়। এই খবরটি আজকাল, সংবাদ, বাংলাবাজার সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ফিলিপিন্স, চীন, বি-টিভি সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন পুরুস্কারে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের একজন কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করে চলেছেন।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী এর সর্বশেষ লেখা

মন্তব্য করুন

Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.