এসিডে পোড়া সুরভি-(ছোট গল্প) =================== নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুরভি, ক্লাসে লেখাপড়ায় সব চেয়ে ভালো ছাত্রী, যেমন ছিলো মেধাবিনী তেমনি ছিলো তার রূপের মাধুর্য। আশেপাশের দু চার গ্রামে যদি রূপবতী মেয়েদের তালিকা করা হতো, তাহলে সুরভীর নামটা তালিকার প্রথমেই লিখতে হতো। হত দরিদ্র পরিবারের দ্বিতীয় কন্যা সুরভি আর এক ছোট ভাই, বাবা রিকশা চালিয়ে সংসার চালায়, বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ২ বছর হলো, এ সংসারে সুন্দরী হওয়াও যে অভিশাপ তার প্রমাণ এই ১৪ বছরে পা রাখা সুরভি, স্কুলে আসতে যেতে প্রায়ই গ্রামের কফিল মেম্বরের বখাটে ছেলে বিরক্ত করতো, সুরভিকে, জোর করে বেশ কয়েকবার ধর্ষণের চেষ্টাও করেছে, প্রভাবশালী মেম্বরের ছেলে, তাই বিচার দিয়েও কোনো সুফল হবে না ভেবে সুরভি মুখ বুজে সহ্য করে যায় বখাটে শাকিলের এই বিরক্তিকর অমানসিক আচরণ। একদিন বিকেলে, স্কুল ছুটির পরে তার অসুস্থ বান্ধবীকে দেখতে গিয়ে একা বাড়িতে ফেরার পথে কফিল মেম্বরের বখাটে ছেলে শাকিল আর তার বন্ধু মিলে জোর করে টেনে হেচড়ে বাগানের ভিতর নিয়ে যাচ্ছিলো ধর্ষণ করতে, এমন সময় সুরভির চিৎকার শুনে দূর থেকে একজন পথচারী ছুটে আসতেই সুরভিকে ছেড়ে দিয়ে বখাটে শাকিল আর তার বন্ধু চলে গেলো, সুরভি বাড়িতে এসে মা বাবার সাথে শাকিলের অসভ্য আচরণ সব খুলে বললো, সুরভির বাবা জানে বিচার দিয়ে কোনো লাভ হবে না, যার কাছে বিচার দেবে তার ছেলেই এমন নিকৃষ্ট কাজ করেছে, আর মুখ বুজে থাকলেও হবে না। দিন দিন শাকিলের অত্যাচার বেড়েই চলেছে, আরো অনেক মেয়েকে শাকিল জোর করে ধর্ষণ করেছে, শালিশ দরবারে সকলের সামনে ক্ষমা চাওয়া আর হাসি মুখে ক্ষমা করে দেয়া, পরের দিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, তবুও সুরভির বাবা শাকিলের বাবাকে গিয়ে সব জানালো, এলাকার আরো মান্যগণ্য কয়েক জনকে বললো, বিকেলে শালিস বসলো, বিচারের রায় হলো, সুরভির কাছে ক্ষমা চাইবে, আর কোনো দিন সে সুরভিসহ অন্য কোনো মেয়েকে বিরক্ত করবে না। সেদিন বিচারের পর থেকে বেশ কয়েকদিন আর সুরভির সামনে পরেনি অসভ্য শাকিল। আজ অনেক দিন বাদে সুরভির সামনে পরলো, একটা বিশ্রী শব্দ ছুড়ে দিলো সুরভির কানের ভিতর, কিরে সুরভি, কেমন আছিস, ও দুটো তো সেদিনের সার পেয়ে অল্প কয়দিনে বেশ বড় হয়েছে দেখছি, ভয়ে সুরভির গা শিউরে উঠলো, ওড়না টেনে আরো আবৃত করে নিলো বুকের যৌবন, ঠিক হঠাৎ বাঘের সামনে পড়লে যেমনটি হয়, বেশ কয়েক গজ দূরত্বে থাকার পরেও যেনো মনে হচ্ছে এখনই কোনো পাগল কুকুর কামড়ে ধরছে তাকে। কুকুরের স্বভাব পরিবর্তন হয় না কোনো কালে, সুরভি চুপচাপ নিরব মাটির দিকে তাকিয়ে হেটে যাচ্ছে। দূর থেকে তাকালে মনে হচ্ছে সুরভি পথের বালুকণাগুলো একের পর এক গুনে যাচ্ছে, বা কাটাবনে সতর্কের সাথে পা ফেলে হেটে যাচ্ছে। পিছন থেকে আবার শব্দ ভেসে আসলো, আমি তোর এই রূপে আগুন জ্বালিয়ে দেবো, তোকে দেখে যেনো সকলে ভয় পায়। সুরভির বুকটা কেঁপে উঠলো আরো কয়েকবার, শাকিলের হুমকি শুনে, কোনো কথা না বলে নিরব মূর্তির মতো ভাষাহীন সামনে হাঁটতে লাগলো, কতক্ষণ পরে পেছনে আর কারো শব্দ অনুভব হলো না, তাকিয়ে দেখলো বিষাক্ত প্রাণীটা নেই, কিছুটা স্বস্তিকর হলো সুরভির ভিতর বাড়ি। ক্লাসের বেশ কয়েকজন সুরভিকে প্রপোজ করেছিলো, সুরভির এক জবাবে তারা শামুকের মতো চুপসে গিয়েছিলো, জবাবটা ছিলো, (ভালোবাসা মানেই আমার কাছে মনে হয়, প্রেমিকার দেহ ভোগের ধান্দা ছাড়া আর কিছু নয়) এর প্রতি উত্তর কারো কাছ থেকে পায়নি কখনো, রাত্র ১২টা ২০ মিনিট, চৈত্রমাসের পূর্ণিমারাত, চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে সারা অন্ধকারের বুকে, দিনের মতোই ফুটফুটে রাতের বুক, গাছের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে ধবল মাটির বুকে, খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে সুরভির শরীরে, সাথে মৃদু শীতল বাতাস। হঠাৎ করে জানালা থেকে আসা আগুন জলে, ভিজে গেলো সুরভির মুখের সম্পূর্ণ অংশ, বুকের কিছু অংশে গিয়েও ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠলো এসিডের কামড়। চিৎকারে সকলে জড়ো হলো, এসিড মারলো কে এতো রাতে, বুঝার কিছুই বাকি রইলো না, মুখ বাঁধা কেউ দৌড়ে পালিয়ে গেলো। অজ্ঞাত অপ্রমাণিত এই দশা। হাসপাতলে নিয়ে ভর্তি করা হলো সুরভিকে, সুরভি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে এলো, তার মুখ দেখে চেনার উপায় ছিলো না যে এই সেই রূপবতী সুরভি, যে কেউ হঠাৎ করে সুরভিকে দেখলেই ভয়ে কেঁপে উঠতো, সুরভি কাউকে নিজের মুখ দেখাতো না, বান্ধবীরাও এক এক করে দূরে সরে গেলো, সুরভির মুখের দিকে কেউ তাকাতো না। অন্য দিকে ফিরে সকলে কথা বললো, আর এই দৃশ্য দেখে সুরভির চোখের জলে বুক ভিজে যেতো। সিথানের বালিশ দিন রাত সুরভির চোখের জল শুষে শুষে ভিজে পুরো হতো। সুরভির প্রবল ইচ্ছে সে পড়াশুনা করবে, সে আবার স্কুলে যেতে শুরু করলো, স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী ওকে দেখে ভয় পেতো, ক্লাসে কেউ সুরভির কাছে বসতো না, ক্লাসের শেষ বেঞ্চে সুরভি একা বসতো, শিক্ষক ও কখনো ওর কাছে গিয়ে দাড়াতো না, একদিন হেড মাস্টার তার কক্ষে ডেকে নিয়ে বললো, তোমাকে দেখে অন্য ছাত্র-ছাত্রী ভয় পায়, তুমি কাল থেকে আর স্কুলে আসবে না। যে শিক্ষক সব সময় সুরভির খোঁজ খবর নিতো, বাবার মতো আদর করতো, তার মুখে এমন কথা শুনে সেখানেই দাঁড়িয়ে অশ্রু জলে ফ্লোর ভিজিয়ে মাথা নত করে বেড়িয়ে এলো, সেদিনের পর থেকে আর সুরভি স্কুলে যায় না। ঘরকোনা হয়ে বসে থাকে সব সময়। বাইরের কারো সাথে দেখা করেনা সুরভি, আয়নায় কবে সেই নিজের মুখ দেখেছে তাও মনে নাই, একদিন নিজের মুখ দেখে নিজেই অবাক হয়েছিলো, সারাদিন কেঁদে কাটালো সুরভি। বিকেলে সুরভির বাবা হাসতে হাসতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেই সুরভিকে ডাকলো, মা সুরভি, কই তুই এদিক আয়... আজ খুশির খবর আছে, জ্বী আব্বা, এই তো আমি, সুরভির মুখে আদর করে হাত বুলিয়ে বললেন, শোন মা, যার কেউ নাই এই জগত সংসারে তার আল্লাহ্ আছেন। আল্লাহ্ উচিৎ বিচার করেছেন। কি বিচার? কফিল মেম্বরের সেই জানোয়ার ছেলে, মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে এমন অবস্থা হয়েছে ওর চেহারা দেখে এখন কেউ চিনতে পারবে না। হাসপাতালে নিতে নিতেই মারা গেছে, গ্রাম থেকে একটা বালামুসিবত আল্লাহ্ তুলে নিয়ে গেছেন। ওর মৃত্যুতে গ্রামের সকলেই খুশি। অনেক দিন বাদে আজ বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো সুরভি। বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো এভাবে। একদিন সুরভির বোনের স্বামী এলো ঢাকা থেকে, সুরভিকে নিয়ে যেতে। সুরভির বোনের একটা বেবী আছে ২ বছর বয়েস, উদ্দেশ্য সারাদিন বাসায় থাকবে আর আপন ভাগ্নিকে দেখাশুনা করবে। সুরভি ঢাকায় এসেও বাইরে তেমন বের হতো না, আর বের হলেও বোরখা পড়ে মুখ ভালো করে ঢেকে বের হতো। যেনো কারো চোখে তার ঝসানো মুখ না প্রকাশ পায়। সুরভির বোন ও বোনের স্বামী দুজনেই গার্মেন্টসে চাকরি করে, সুরভি ঢাকায় এসে বেশ ভালোই আরাম বোধ করছে, আশে পাশের বাসার ভারাটিয়ারা প্রথম প্রথম বিরক্তির চোখে দেখলেও পরে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছে তারা। মাস খানেক পরে একদিন সুরভির ভগ্নীপতি বাসায় ফিরলো, সুরভি ভেবেছে হয়ত শরীর খারাপ তাই বাসায় চলে এসেছে, এসেই খাটে শুয়ে পড়লো, সুরভিকে বললো তার শরীর খুব ব্যথা করছে, একটু টিপে দিতে, সুরভি সরল মনে তার শরীর টিপে দিতে লাগলো, এক পর্যায়ে নানান অযুহাত দেখিয়ে সুরভির সব কিছু লুটে নিলো তার বোনের স্বামী। এভাবে মাসের পর মাস তার দেহ ভোগ করতে লাগলো, লোভী বোনের স্বামী, বোনকে বলেও লাভ হলো না, বোন হলো অন্ধ স্বামীভক্ত। কয়েক মাস পরে সুরভির শরীরে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেলো, সুরভি বুঝতে পারলো তার এই ঝলসানো নির্যাতিত শরীরের মাঝে আরো এক শরীর ধীরেনধীরে বেড়ে উঠছে। সুরভিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিলো আর এক পাপ বেড়ে ওঠার নাড়ী। এভাবে প্রায় প্রতিদিন তার বোনের স্বামী বন্ধুদের নিয়ে এসেও পালাক্রমে তার দেহ ভোগ করতো। সুরভি রাজি না হলে তার উপর চলে অমানসিক নির্যাতন। আপন বোন সেও টাকার লোভে অন্ধ হয়েছে, বোনের প্রতি কোনো মায়া নেই, ডিম পাড়া সোনার হাস হলো সুরভি। সুরভি মুখ বুজে সব নির্যাতন ঝলাসানো শরীরে সইতে থাকে অশ্রুসিক্ত হয়ে থাকে সব সময়। একদিন দুপুরে কাষ্টমার নিয়ে বাসায় এসে দেখে, সকল কোলাহল অত্যাচার নির্যাতন ধর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে সুরভি ফ্যানের সাথে প্রাণহীন ঝুলে অপেক্ষা করছে। সাদা ৫ খন্ড মার্কহীন কাপড়ের। সুরভির পায়ের সোজাসুজি একটা চিরকুট পরে আছে। তাতে লেখাছিলো। বোন, আমি আবারো অবৈধ সন্তানের মা হতে চলেছি। ওরা যখন আমায় নিয়ে আনন্দে মাতে আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা পাই, আমার মাঝে যে বেড়ে উঠছে তাকেও আবার হত্যা করতে হবে, আমি বেঁচে থাকলে এভাবে আরো অসংখ্য শরীরের জন্ম হবে যারা পৃথিবী দেখার আগেই ডাস্টবিনে চলে যাবে। তার চেয়ে আমি নিজেই নিজের মুক্তি দিলাম। বোন, যদি পারিস, আমার এই পাপের শরীর জলে ভাসিয়ে দিস, পবিত্র মাটিতে দাফন দিলে মাটিও আমায় ঘৃণায় উগড়ে তুলে ফেলে দিবে, তোরা ভালো থাকিস। ( সমাপ্ত)