সংকোচে সর্বনাশ খুব যে সুশ্রী সুন্দরী তা বলা যায় না, তবে অসুন্দরীও নয়, মাঝারী গড়ন ফরসা গোলাকার চাকমাদের মত মুখমন্ডল, কপাল ছোট, তার নীচে টানা চোখ কালো। ভ্রু-জোড়া বাঁকানো চিকন। সরু উচু নাক। মাথায় কুচকুচে কালো রেশমী চুল কিন্তু ববকাট। ওষ্ঠ-অধর দু'টোই পাতলা লাল। অধরটা লাল বেশি। হাসিটা বেশ মজার। মৃদু মৃদু হাসে, কখনো অট্টহাসি হাসতে দেখিনি তাকে। মৃদু হাসির কারণে ছোট্ট ছোট্ট দাঁতের পাটি প্রায় অদেখাই থেকে যায় দর্শকদের। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে যে, বোধহয় দাঁত'ই নেই তার। কখনো সখনো যদি খিলখিল করে হাসে, বাম গালে টোল পড়ে যায় তখন। পিঠ খোলা ব্লাউজ পড়ে আসে অফিসে, বুকের আঁচল প্রায় প্রায়ই স্থানচ্যূত হয়ে যায়, তাই স্তন যুগলের আকার সমন্ধেও ধারণা হয়েছে যে, বেশ সুডৌল আর দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণই মনে হয়েছে আমার। একটু লম্বা আর মুখমন্ডল লম্বাটে হলে চঞ্চলা হরিণী'ই বলা যেত তাকে। তা কিন্তু নয় সে, বরং বেশ গম্ভীরভাব নিয়েই অফিসে বসে আমার পাশের টেবিলে। মাঝে মাঝে যে ঠাট্টা রসিকতা চলে না এমনটাও নয়, তবে খুব বেশী ব্যক্তিগত কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে। আমাদের অফিসের জুনিয়র ক্লার্ক...একবছর হলো জয়েন করেছে প্রথম। আমি সিনিয়র, তার সঙ্গে বেশি ফষ্টিনষ্টি করার ইচ্ছে বা প্রবণতাও ছিল না আমার। পজিশনও তা সাপোর্ট করে না। অফিসে তিনজন সিনিয়র কর্মকর্তার মধ্যে আমি একজন। এক বাপের এক ছেলে। বেশ প্রাচুর্য্যের মধ্যেই মানুষ হয়েছি। বাবা মাধ্যমিক স্কুলের হেড মাষ্টার মা-ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সচ্ছ্বল সংসারের ছেলে হওয়া সত্বেও বেশ লাজুক আর ভীরু প্রকৃতির স্বভাবের কারণে লিখতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, চলা বলায় ততটা স্মার্ট হতে পারিনি। বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে সাবলীল হতে পারিনি এখনও, ফষ্টিনষ্টি তো দূরের কথা। সে ছাড়া আরো তিনজন মহিলা কর্মচারী আছেন অফিসে, তারা সবাই স্যার বলে আমাকে। এক্ষেত্রে যতটা সংযত হওয়া দরকার তারও অধিক সংযত হয়ে থাকি অফিসে। তার থেকে প্রায় ফুট খানেক লম্বা আমি, দোহারা গঠন, শ্যামলা রঙ গায়ের। কলেজ ভার্সিটিতে কতজনই কত কি করে দ্রষ্টব্য হয়েছিল অথচ আমি ভাল ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও শুধু ভদ্রতার সার্টিফিকেট নিয়েই সন্তষ্ট থেকেছি। কত শত সহপাঠিনীর সাথে পড়াশুনা করেছি কত বছর ধরে অথচ নারীঘটিত সুনাম দুর্নাম কিছুই অর্জন করতে পারিনি সে কেবল আমার মুখচোরা স্বভাবের কারণে। আজ তিনদিন থেকে অফিসে অনুপস্থিত সে। শুনলাম কি এক বিশেষ কারণে ছুটিতে আছে। মনটা ভাল লাগছে না, জানি না তার না থাকার কারনে নাকি! মনে মনে ভাবছিলাম একটা কথা বলব তাকে...একদম ব্যক্তিগত কিন্তু ঐ যে আমার স্বভাবগত সংকোচ বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বৈশাখের শুরু থেকে বেশ কয়েকজন ঘটকের আনাগোনা দেখছি বাড়িতে। বাবা-মায়ের কিছু আলাপ কানে এসেছে, যে করেই হোক এ মাসের মধ্যেই আমার বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে চায় তারা। বাবা খুব বাস্তববাদী লোক। মাকে নাকি বলেছেন আমাকে বলতে "আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা? যদি থাকে তবে স্পষ্ট করেই যেন তার নাম ঠিকানা জানিয়ে দেই। লাজুক ভীরু বলেই আমি একটু বেশীই মা ঘেঁষা। কয়দিন আগে থেকে মা বারবার তুলেছে কথাটা আমার কাছে। আমি বেশ জোরের সাথেই উত্তর দিয়েছি, না মা, তেমন কেউ-ই নেই আমার, তোমরা যেখানে খুশি ব্যবস্থা করতে পারো। সে কারণেই হয়তো বা ঘটকদের আনাগোনা বাড়ছে। তিনদিন থেকে অফিসে এসে বামপাশের চেয়ার টেবিল ফাঁকা দেখে দেখে মনটা কেমন যেন করছে...ঠিক বুঝতেও পারছি না তার কারনটা কি? কারণটা যদি সে-ই হয়ে থাকে, তবে তো তাকেই দেয়া যায় প্রস্তাবটা কিম্বা বাবা-মা'কে জানানো যায়। কি করা উচিৎ ভাবতে ভাবতেই দেখি অফিসে প্রবেশ করলো সে। ধক্ করে আমার হার্টের একটা বিট যেন থেমে গেল। আবার যখন চালু হলো ততক্ষণে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। বেশ ঝলমলে পোশাক পড়েছে, মুখের উজ্জ্বলতাও যেন বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। আমাকে সালাম দিয়েই চলে গেল বস এর রুমে। শতভাগ মনস্থির করে ফেললাম, আজকে এক্ষুনি দিয়ে দেব প্রস্তাবটা। কিছুটা আফসোস করলাম মনে মনে...ইস্! আরো আগেই কেন দৃঢ় করিনি সম্পর্কটা। সামান্য একটু চেষ্টা করলেই হাতের মুঠোয় আনা যেত অনায়াসে । যাক্ যা হবার হয়ে গেছে , সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে এক্ষনই বলে ফেলবো কথাটা । অফিস ছুটি হতে মাত্র আধাঘন্টার মত সময় বাকী আছে। ছুটির পরে ভাল একটা চায়ের দোকানে নিয়ে যাবো তাকে, তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ কৌশল করে বলব কথাটা তাকে। ভাবনা'র শেষ মুহূর্তে ফেরত এলো সে বস এর রুম থেকে। আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফুট খানেক লম্বা বেশ সুন্দর অলঙ্করণ করা সোনালী রঙের একটা খাম বের করে বলল, স্যার, আগামী সপ্তাহে আমার বিয়ে, অবশ্যই আসবেন কিন্তু..। কার্ডযুক্ত খামটা হাতে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে সে। আমার হার্টবিট থেমে গেছে অনেক্ষণ..আহাম্মকের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি তার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। খামটা টেবিলে রেখে ধীরে ধীরে মরাল গমনে বেরিয়ে গেল সে অফিস কক্ষ থেকে । ঢং ঢং শব্দে পাঁচটা বাজার সংকেত দিল দেয়াল ঘড়ি । কর্মকর্তা কর্মচারী সবাই ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো । এতক্ষণে দম ফিরে পেলাম যেন... অনিচ্ছাসত্বেও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে, ধপ করে বসে পড়লাম চেয়ারে।
শেয়ার করুন
প্রকাশিত বিভাগ ছোট গল্প

প্রকাশ চন্দ্র
প্রকাশ চন্দ্র জন্ম ১৯৬২ ইং ৪ঠা ডিসেম্বর । নিজস্ব চেম্বার "হোমিও প্রাকটিস সেণ্টার" (প্রধান চিকিৎসক) পিতা মৃত যোগেন্দ্র নাথ রায় । মাতা মৃত শৈলেশ্বরী দেবী রায় । তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ। ১৯৮২ সালে রংপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে ডি.এইচ.এম.এস. ডিগ্রী অর্জন করেন । এক ছেলে, প্রেমপ্রদত্ত রায় এবং এক মেয়ে প্রীতিপ্রভা রায়। স্ত্রী চামেলী রাণী রায়, কিণ্ডারগার্ডেন স্কুলের টিচার ।
প্রকাশ চন্দ্র এর সর্বশেষ লেখা
5 মন্তব্য
- মন্তব্যের লিঙ্ক
শুক্রবার, 27 নভেম্বর 2020 02:57 লিখেছেন ইদি আমিন
অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম,,,, বেশ চমৎকার
- মন্তব্যের লিঙ্ক
সোমবার, 23 নভেম্বর 2020 20:58 লিখেছেন নাজমুল কবির
চমৎকার একটা ছোট গল্প লিখেছেন দাদা ভাই।
- মন্তব্যের লিঙ্ক
সোমবার, 23 নভেম্বর 2020 20:58 লিখেছেন নাজমুল কবির
চমৎকার একটা ছোট গল্প লিখেছেন দাদা ভাই।
- মন্তব্যের লিঙ্ক
সোমবার, 23 নভেম্বর 2020 20:58 লিখেছেন নাজমুল কবির
চমৎকার একটা ছোট গল্প লিখেছেন দাদা ভাই।
- মন্তব্যের লিঙ্ক
সোমবার, 23 নভেম্বর 2020 20:58 লিখেছেন নাজমুল কবির
চমৎকার একটা ছোট গল্প লিখেছেন দাদা ভাই।
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.