এই পৃষ্ঠা প্রিন্ট করুন
বুধবার, 25 আগষ্ট 2021 20:46

আনন্দ নিকেতন নির্বাচিত

লিখেছেন
লেখায় ভোট দিন
(0 টি ভোট)
                আনন্দ নিকেতন                

আনোয়ার ঈশিতার সম্পর্ক অনেক দিনের। আনোয়ার যখন মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষে, ঈশিতার বাড়িতে তখন  ঘটকের আসা-যাওয়া। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা, কখন বৃষ্টি নামবে কে জানে। 
ঈশিতা বলেই ফেলল তাদের সম্পর্কের কথা।l পরিবারের যেন বজ্রপাত নেমে এলো। মুখার্জি পরিবারের সঙ্গে শেখ পরিবারের বিয়ে অসম্ভব। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তারা ব্যর্থ হলো তাদের শিক্ষা দিয়ে সমাজকে পরাজিত করতে। 

সমাজ শৃঙ্খলা ছিন্ন করে ঘর বাঁধলো বাতাসপুর গ্রামীণ হাসপাতালের কামরায়। খুব আনন্দেই কাটছিল তাদের জীবন। মনে একটা চাপা কষ্ট ছিল দুজনেরই তাদের পরিবারের জন্য। দুটি বছর অনাবিল আনন্দে প্রকৃতির ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে এলো সন্তানের কুঁড়ি। ইতিমধ্যে মারণব্যাধি কোভিডের সঙ্গে যুদ্ধে বাতাসপুর এর ভরসা ডাক্তারবাবুর দিন-রাতের পরিশ্রম। তাদের এত সুখ বিধাতা সইতে পারলেন না। একদিন ঐ ভাইরাসই সঙ্গে নিয়ে গেল ডাক্তারবাবুকে। জন্মের আগেই পিতৃহারা হল হবু সন্তান। 

ঈশিতা অসুস্থ হয়ে পরে। মাথার ওপর নিকষ কালো আকাশ। বাতাসপুরের অনিতা দি তার কাজের লোক, সেই তার দেখাশোনা করতে লাগলো। নার্সিং পাশ থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তারবাবুর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ওই হাসপাতালেই তাকে নার্সিং কাজে নিযুক্ত করে। খবর পেয়ে বাড়ির লোক নিতে আসে তাকে। কিন্তু স্মৃতি তাকে যেতে দেয় না। কয়েক মাস পরই সে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। আনোয়ারের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার, আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ে দুচোখ বেয়ে। বাতাসপুরের জল মাটি বাতাসে বাড়তে থাকে তাদের ভালোবাসার ফসল। বাতাসপুরের প্রকৃত দিদি হয়ে ওঠে ঈশিতা। কিন্তু বিধি বাম, সুখ কথাটা বেধহয় বিধাতা পুরুষ  ঈশিতার কপাল থেকে ডিলিট করে ফেলেছেন। 

দু বছর বয়সেই ছেলের হার্টের সমস্যা ধরা পড়ল। অনেক চেষ্টার পরেও শেষ রক্ষা হল না। আল্লাহ আনোয়ারের দেওয়া শেষ উপহার টুকুও কেড়ে নিল একদিন। ওর পোড়া হৃদয়ের উত্তপ্ত মোম যেন পড়তে লাগল চোখ দিয়ে। এ ভাবে আর থাকা যায় না। সিদ্ধান্ত নেয় বাতাসপুর ছাড়ার। গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আর সরলতা তার পথ রুদ্ধ করে। 

একদিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে প্রসব করিয়ে বাড়ি ফেরার পথে, ঝোপের পাশ থেকে শুনতে পায় শিশুর কান্নার আওয়াজ। কোলে তুলে নিতেই তার কান্না বন্ধ হেসে ওঠে শিশুটি। ফুটফুটে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে এসে অনিতা দিকে বলে, " এই নাও, আজ থেকে তোমার মাইনে আরো 500 টাকা বাড়লো। " গ্রামের আরো দুটো অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিল ঈশিতা। 

ইতিমধ্যে এন জি ও র দায়িত্ব থাকা শুভর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। ছেলে আনন্দ কে স্মরণ রাখার জন্য তার এনজিওর নাম দিয়েছে" আনন্দ নিকেতন। " এ ভাবেই কেটেছিল কয়েকটা বছর। শুভ ও বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছে আনন্দ নিকেতনে। দুজনেই সম্পর্কের একটা টান অনুভব করছিল। শুভর ও বাবা-মা কেউ নেই। তাই সে একদিন খোলক থেকে বেরিয়ে বলল, " সেও তো অনাথ তার কি এই আনন্দ নিকেতনে একটুও জায়গা হবে না! "
 সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটলো আরো কয়েকটা মাস। শেষে ঈশিতা তার বর্তমান অভিভাবক অনিতাদি  কে বললো শুভর কথা। অনিতাদি বললো, " দিদি গো এ সমাজে মেয়ে মানুষের একা থাকার অনেক জ্বালা। তুমি শুভ দাদাবাবুকে মনের আনন্দ নিকেতনে স্থান দাও। " ঘোলাটে আকাশ থেকে ঝিরিঝিরে বৃষ্টি নামল। ভিজল ঈষিতা, প্রাণ ভরে জল মাখল। আনোয়ার যেন পুষ্প বৃষ্টি দিয়ে স্বাগত জানাল।

শুভর স্থায়ী ঠিকানা হলো আনন্দ নিকেতন। কিছুদিন পর তারা অনিতাদি কে সঙ্গে নিয়ে  রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করল। সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে গেল।সেদিন গোটা বাতাসপুরের বাতাসে যেন গোলাপের সুবাস। সকলেই খুব খুশি।

 কয়েক বছরের মধ্যেই শুভর পরিশ্রমে আনন্দনিকেতন রূপে বসন্তের বাহার। গাছপালায় ভরে উঠলো, অনেকে জমি দান করল। বিভিন্ন জায়গা থেকে এমনকি বিদেশ থেকে অনুদান আসতে লাগলো। পুকুর কাটা হলো অনেক কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হল। স্কুল গড়ে উঠল ধীরে ধীরে। সেখানে পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াও সেলাই, বুটিক, টেরাকোটা, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র মেরামতি ইত্যাদি নানান কাজ হাতে কলমে শেখানোর ব্যবস্থা হল। যাতে বড় হয়ে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। প্রতিটি শিশুর মধ্যে ঈশিতা খুঁজে পেত তার আনন্দ কে। তাই তারা আর কোনো সন্তান নেয়নি। এখন সে অনেক সন্তানের জননী। 

শুভ তার পরিশ্রম দিয়ে ভালোবাসার মানুষের মধ্যে সুখ খুঁজে নিত। আনন্দ নিকেতনের তারাই যেন প্রকৃত পিতা মাতা। আনন্দ নিকেতন অনাথ শিশুদের সেরা ঠিকানা হয়ে উঠলো। 

এদিকে শুভর ভালো কাজের জন্য দিল্লি থেকে ডাক পড়লো। এদিকে অনিতা দি বয়স জনিত কারনে সকলের মায়া কাটিয়ে শেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। অনেক বড় কাজের দায়িত্ব সামলাতে যেতে হবে দিল্লি। প্রথমে যেতে রাজি হয়নি, ঈশিতা অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। 
মাসে একবার আসে কয়েকদিন থাকে আবার চলে যায়। এ ভাবেই কাটছিল তাদের দিন। 

দিল্লিতে কাজের চাপে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয়না। ওখানে পরিচয় হয় স্মিতা সাক্সেনার সঙ্গে। সেও এনজিওর সাথে যুক্ত শুভর খুব খেয়ালও রাখতো। শরীর খারাপ হলে দেখাশোনা করা, কখনো-সখনো খাবার পৌঁছে দেওয়া এইসব আরকি। এইভাবে একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটা ঈশিতা মেনে মেনে নিতে পারে না। যদিও সম্পর্কটা ছিল দিদি ভাইয়ের মতোই। 
প্রতি বছরের মতো আনন্দ নিকেতন থেকে পিকনিকে দীঘা যাওয়ার কথা ঠিক হয়। 

দীঘা যাবার আনন্দে সবাই যখন মশগুল তখন শুভর কাছে দিল্লি থেকে ফোন আসে। স্মিতাদির  অবস্থা ভালো না তাকে দিল্লি যেতে হবে। ঈশিতা নিষেধ সত্ত্বেও শুভ দিল্লি যায়।ঈষিতা মুষড়ে পরে। ওখানে স্মিতা সাক্সেনের হার্টের অবস্থা ভালো না অপারেশন হয়। পর দিন একটু সুস্থ বোধ করেন। 

তখন আবার দীঘা থেকে খবর আসে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য। সমুদ্র স্নানের সময় এক শিশু বালি ছোড়ে, সরাসরি এসে লাগে ঈষিতার চোখে। তারপর থেকেই আবছা দেখতে শুরু করে। ফ্লাইটে ফিরে আসে শুভ। কলকাতায় ডাক্তার দেখিয়ে বুঝতে পারে চোখে আর দেখতে পাবে না ঈশিতা। বাস্তবিক আঁধারের রূপ দেখতে থাকে ঈষিতা। শুভকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কোন আশ্বাসের বাণী তার নদীর ধারা কে রুখতে পারছেনা। এরপর চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের  একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক কিছুটা আশার আলো দেখান। তিনি বলেন এমন একজন আই ডেনার চাই, যার সবকিছু ওনার সঙ্গে ম্যাচ করবে। 

শুভ একটা চোখ তৎক্ষণাৎ দিতে চাইল। আরো কয়েকজন ডোনার এল। কিন্তু না কোনটাই ম্যাচ করল না। যে শিশুটির জন্য তার এমন অবস্থা, সেও বললো" আমি মাকে চোখ দেবো, মা আমাকে দেখবে। আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো। " শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো ঈশিতা। বলল "বাবা তুই আমার নয়নের মনি, আমার আনন্দ। "

       স্মিতাদি সুস্থ হয়ে খোঁজ-খবর নিলেন, একদিন দেখতে এলেন ঈশিতাকে। ঈশিতা ভাল করে কথাই বলল না। যেন তার জন্যই তার এই অবস্থা। এদিকে যখন সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ তখন ডাক্তারবাবু বললেন "একজন ডোনার পাওয়া গেছে, যার সমস্ত টাই ম্যাচ করছে। কিন্তু...."
'কোনো কিন্তু নয় বলুন আপনি, যা করতে হয়  আমি করব। বিনিময়ে আপনি আমার স্ত্রীর চোখ ফিরিয়ে দিন। " শুভ তটস্থ হয়ে উঠল। "অন্য কিছু না ১৫ লক্ষ টাকা লাগবে, আর লেনদেন আমার সঙ্গেই হবে। ডোনারের সঙ্গে দেখা হবে না।" শুভ বললো আমি রাজি, আপনি যা করতে হয় করুন। শুভ চাকরি থেকে ভি আর এস নিয়ে টাকা যোগার করল।

    আপারেশন সাকসেসফুল। আবার দেখতে পাচ্ছে ঈষিতা। কি আনন্দ তার, ফুল মিষ্টি নিয়ে ডাক্তার বাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলো। ঈষিতা বলল," স্যার, যার জন্য আমার চোখের এই আলো তাকে দুচোখ ভরে দেখতে চাই।  "কিন্তু ওটাতো শর্তেই ছিল। "ডাক্তারবাবু ফোনে কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর বললেন ঠিক আছে, ওনাকে বেশি কথা বলাবেন না ওনার অবস্থা ভালো না।

ওরা যাবার জন্য উঠছিল, ডাক্তারবাবু বললেন দাঁড়ান,এই নিনি আপনাদের টাকা। উনি কোনো টাকা নেননি। দুজনেই অবাক! দুজনের ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। ডোনার আর কেউ নয় স্মিতা সাক্সেনা।

 স্মিতাদির এক চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা আরেক চোখে মৃদু হাসি। বললেন তোমাদের এই খুশি মুখটা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। ঈশিতার চোখ জলে ভিজে ওঠে। বলে," দিদি, আপনাকে বাঁচতেই হবে আমাদের জন্য। 
"ডাক্তারবাবু বললেন, " আমি নিষেধ করেছিলাম উনি শোনেন নি।" উনি বলেছিলেন, " ডাক্তার বাবু আমার জীবনের থেকে ওদের বেঁচে থাকা অনেক জরুরী, কতগুলো শিশুর প্রাণ বাঁচবে আপনি জানেন না। " আরও বলেছিলেন, " টাকার কথা বলবেন তা না হলে ওরা বিশ্বাস করবে না। আর্ এই ব্যাপারটা গোপন রাখবেন। আপনার পারিশ্রমিক আমি দিয়ে দেব। " এত মহৎ কাজ করেন আপনারা,এত মহৎ দান ওনার, আমি আর কোন পারিশ্রমিক নিতে পারিনি। চলে গেলেন ডাক্তারবাবু। 

ঈশিতা কে বলল, " তুমি চোখের জল ফেলো না বোন, ক্ষতি হতে পারে। তোমার সব কথা শুভর মুখে শুনেছি। তোমার গুণের কথা তোমার ভালোবাসার কথা সব, শুভ আমাকে দিদি বলে খুব ভালোবাসে। এখন থেকে আমার চোখ আর তোমার হৃদয় দিয়ে আনন্দ নিকেতন এর শ্রীবৃদ্ধি দেখব। আমার যা কিছু সম্পদ আমি সব আনন্দ নিকেতনের নামে উইল করে দিয়েছি। এমন সময় নার্স এসে কথা বলতে বারণ করলেন। শেষে বললেন, " ভালো থেকো বোন। " 

না, উনি আর বেশিদিন বাঁচেন নি। ওখানে মারা যান ওখানেই সৎকার্য করে শুভ। স্মিতাদির চিতা ভষ্ম নিয়ে আসে ঈষিতা। তার ওপর একটা উঁচু জায়গায় স্মিতা সাক্সেনার একটা বড় মূর্তি স্থাপন করা হয়। ঈষিতা বলে, ' আমর অন্ধকার পৃথিবীতে আলো দেখিয়েছেন উনি। আলোদি তুমি হৃদয়ে থেকো। " 

ঈশিতা অনুভব করে তারপর থেকে আলোদি যেন প্রতিদিন আনন্দ নিকেতন এর ভালো মন্দ দেখাশোনা করেন। 
এমন মনুষ্যত্ব দিকে দিকে বিকশিত হোক। 
     
                        ★ সমাপ্ত ★            
            
452 বার পড়া হয়েছে সর্বশেষ হালনাগাদ বুধবার, 01 সেপ্টেম্বর 2021 18:49
শেয়ার করুন
রমাকান্ত পাঁজা

রমাকান্ত পাঁজা, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার নবস্থা গ্রামের বাসিন্দা। পিতা জগন্নাথ পাঁজা ও মাতা বাসন্তী পাঁজা। ১৯৭৪ সালে ১৭ ই নভেম্বর নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। গ্রামের স্কুলে পাঠ শেষে কারিগরি ঞ্জানের জন্য শহরে গমন। বর্তমানে গৃহশিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত।

রমাকান্ত পাঁজা এর সর্বশেষ লেখা