ইদানিং প্রায়ই মধ্যরাঁতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় মাহমুদের।একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর ঘুমুতে যায়না।কিছুক্ষন স্থির হয়ে বসে আনমনে কি যেন ভাবে।তারপর নিঃশব্দে ড্রয়ারের ভেতর জরাজীর্ণ ডায়েরির খোঁজ করে।ডায়েরির স্পর্শ অনুভব করা মাত্রই হৃদস্পন্দন কিছুটা কমে যায়। মাহমুদের দেশের বাড়ি বরগুনা।তবে ঢাকা শহরেই তার বেড়ে উঠা এবং পড়াশুনা।চার ভাই -বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়।বড় ভাই মাইনুল ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে এখন একটি মাল্টিলেভেল কোম্পানিতে চাকরি করছে।মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর GRE(Graduate Record Exam) দিয়ে R.A(Research Assistant)হিসেবে স্কলারশিপ পেয়ে এখন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে গণিতের উপর।প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জগৎবিখ্যাত ছাত্র ছিলেন জন ন্যাশ,যিনি গণিতবিদ হয়েও ১৯৯৪ সালে “গেম থিওরির” উপর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।একমাত্র আদরের বোন মহুয়া ইডেন কলেজে ইতিহাসে পড়ে।দেখতে শুনতে বেশ ভালো।ইদানিং প্রায়ই তার বিয়ের প্রস্তাব আসছে।মহুয়ার অবশ্য সেই দিকে খুব বেশি খেয়াল নেই।পড়াশুনার প্রতিই সে বেশি মনোযোগী।ভাইয়ের মত সেও উচ্চশিক্ষা অর্জনে আগ্রহী।পরিবারের সবার ছোট আরিফ এ বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিল।ভাইবোনের মধ্যে আরিফের মেধা সবচেয়ে ভালো।যদিও গতানুগতিক পড়াশুনায় সে খুব বেশী আগ্রহী নয়।আর তাইতো ওকে নিয়েই একটু দুশ্চিন্তা পরিবাবের অন্য সবার। ছেলেবেলা থেকেই বইপড়ার প্রতি দারুন ঝোঁক মাহমুদের।কোন বই পড়া শুরু করলে সেটা শেষ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেই।বই পড়তে পড়তে একসময় লিখালিখিও কিছুটা রপ্ত করে ফেলে মাহমুদ। মুহূর্তের মধ্যে কবিতা আর গল্প লিখে ফেলার দারুন প্রতিভার কারনে বন্ধু মহলে স্বভাব কবি হিসেবে ছেলেবেলায় উপাধি পেয়ে যান।কেউ কেউ আবার তাকে জুনিয়র গোবিন্দ্র দাস(স্বভাব কবি) বলে ডাকতে শুরু করে।মাহমুদের বয়স একযুগ পূর্তি উপলক্ষে ছোট মামা পল্টু মাহমুদকে একটা ছোট্ট লাল ডায়েরি উপহার দেন।সে ডায়েরির পুরোটা জুড়েই স্থান পায় মাহমুদের কবিতা। মাহমুদের বাবা মিজানুর রহমান পুরোদস্তুর সাহিত্যমনা মানুষ।লিও তলস্তয় থেকে মার্ক টয়েন সবই তার পড়া।মাহমুদের শিল্প সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক তার বাবার কারণেই।মিজানুর রহমান ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে চাকরি করতেন।সরকারি চাকরির সামান্য মাইনে দিয়ে চার ছেলে মেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকা বেশ সংগিন হয়ে গেলে তার সহধর্মিণী তাকে পরামর্শ দেয় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি শেখার জন্য।বছর তিনেক পড়াশুনা আর দূরসম্পর্কের এক চাচাত ভাইয়ের দোকানে কিছুদিন থাকার পর কারওয়ান বাজারে টিনশেডের একটা দোকান ভাড়া নেন।অফিস শেষ করে বাসায় এসে একটা চা আর কিছু বিস্কুট খেয়ে মাগরিবের নামাজ পরে দোকান খুলতে যেতেন।অমায়িক ব্যবহার ,চারিত্রিক দৃঢ়তা আর সেবাদানকারী মনোভাবের কারনে অল্পদিনেই বেশ পরিচিত হয়ে যান।দু বেলা ডাল ভাত খেলেও ছেলেমেয়ের পড়াশুনা ঠিকমত চালাতে পেরে মিজান সাহেব সবসময় সৃষ্টিকর্তার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করতেন।যতদিন বেঁচে ছিলেন ছেলেমেয়েদের একটি কথা প্রায়ই বলতেন,“জীবনের সেই কঠিন সময় তোদের মায়ের সেই পরামর্শের জন্যই আজ আল্লাহর রহমতে তোদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছে।এই মাকে কোনদিন কষ্ট দিবিনা”। মাহমুদ জানতোনা যে তার কবিতার সবচেয়ে বড় পাঠক ছিলেন তার বাবা।কবিতার তিনি এতই ভক্ত যে,শুধু নিজে পড়ে তৃপ্তি হতেন না।তাইতো প্রতিদিন অফিসে মাহমুদের লাল ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে যেতেন।অবসরে আবৃত্তি করে শোনাতেন সহকর্মীদের।মাহমুদ যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে একদিন হঠাৎ তার বাবার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়।বাসায় ফিরে মহুয়াকে বলেন এক গ্লাস পানি দিতে। কিন্তু মহুয়া পানি আনার পূর্বেই তিনি সবাইকে রেখে চলে যান না ফেরার দেশে।জীবনসঙ্গীর এই আকস্মিক বিয়োগে ভেঙ্গে পড়েনা স্ত্রী রোকেয়া বেগম।ধৈর্য ধরে সংসারের হাল ধরেন।মিজানুর রহমানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন ইউসুফ মিয়া,তিনি হোমিও প্যাথিক ডাক্তার।মিজান সাহেবের ইন্তেকালের পর কারওয়ান বাজারের দোকানটি যখন বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল তখন এই ইউসুফ মিয়াই দেবদূতের মত এসে এই বিপদের দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান।একবেলা তার নিজের দোকানে চেম্বার করতেন অন্যবেলা বন্ধুর দোকানে।কিছুদিন পর এই জান্নাতি মানুষটিও চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যুর কিছুদিন পর মাহমুদ বাবার অফিসে যায় পেনশনের কাগজপত্র তুলতে।অফিসের যে টেবিলটায় তিনি বসতেন সেই টেবিলটা তখনো খালি পড়ে ছিল।বাবার চশমা আর প্রয়োজনীয় কিছু কাজপত্র নেবার জন্য ড্রয়ার খুলতেই চোখে পড়ে ছেলেবেলার সেই ডায়েরি।অফিসের সহকর্মীরা জানালো, তার বাবা তার কবিতা কত ভালবাসত ! বাবার মৃত্যুর সময় মাহমুদ এক বিন্দুও কাঁদেনি।কিন্তু এবার আর চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারল না।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল বেশ কিছুক্ষণ। দূরদেশে পড়তে এসেও তাইতো মাহমুদ বাবার ভালোবাসা মাখা ডায়েরিটা সবসময় কাছে কাছে রাখে।চোখের আড়াল হলেই কেমন জানি উদ্বিগ্ন হয়ে যায়।আর উদ্বিগ্ন হবেনাই বা কেন ? কারণ এ ডায়েরির মাঝেই তো লুকিয়ে আছে বাবার ভালোবাসার পরশ।
শেয়ার করুন
প্রকাশিত বিভাগ ছোট গল্প

আল মামুন উর রশিদ
একটি সুন্দর গল্প মানুষকে হেরার পথ দেখাতে পারে...
আল মামুন উর রশিদ এর সর্বশেষ লেখা
6 মন্তব্য
- মন্তব্যের লিঙ্ক
রবিবার, 16 জুলাই 2023 04:07 লিখেছেন EptIcTb
Fertility Therapy propecia before and after
- মন্তব্যের লিঙ্ক
শুক্রবার, 12 জুন 2015 10:00 লিখেছেন সুজন হোসাইন
খুব ভালো লাগলো
- মন্তব্যের লিঙ্ক
বৃহষ্পতিবার, 11 জুন 2015 00:26 লিখেছেন সার্জেন্ট মোঃ নাজমুল কবির (অবঃ)
খুব ভালো লেগেছে বাবার ডাইরীর গল্প, অসম
- মন্তব্যের লিঙ্ক
বুধবার, 10 জুন 2015 10:01 লিখেছেন সীমান্ত মুরাদ
অনেক অনেক ভালো লাগল
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.