ভাবনার গল্প অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ১ অনেকদিন আগের কথা। কয়েকজন মানুষ আদালত পাড়ার সামনে টাইপ রাইটার নিয়ে বসতো। প্রচুর কাজ তারা সারাদিন ধরে করতো। আয় উপার্জনও বেশ ভালো ছিল। সুখেই তাদের সংসার চলছিল। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তো থেমে থাকেনা। এটা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ধারায় এলো কম্পিউটার। লোকজন কম্পিউটারের প্রতি ঝুকে পড়লো। যারা টাইপ রাইটার নিয়ে বসেছিল, তাদের কাছে আর কেউ যেতোনা | তাদের দুর্দিন দেখা দিলো | এদের মধ্যে কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলো তারা নিজেদের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত করে নিবে | তারা পরিবর্তনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলো | এরপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কম্পিউটার শিখার উদ্যোগ গ্রহণ করলো | তারা খুব দ্রুত তাদের নিজেদের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিলো এবং তাদের আয় উপার্জন আগের থেকে অনেক বেড়ে গেলো | তারা নিজেরা সমৃদ্ধ হলো আর সংসারে আগের চেয়ে সমৃদ্ধি নিয়ে এলো | কিন্তু তাদের মধ্যে বাকি যারা ছিল তারা পরিবর্তনকে বোঝা হিসেবে মনে করলো | তারা নিজেদেরকে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে ভয় ও অনাগ্রহ প্রকাশ করলো | তারা দিন মজুর হিসেবে কাজ করা শুরু করলো | কোনোদিন কাজ পেতো আর কোনোদিন পেতোনা | তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লো আর সংসারে অশান্তি নেমে এলো | সময় বদলায়, তার সাথে আসে প্রযুক্তির পরিবর্তন | যারা সেই পরিবর্তনের সাথে চলতে পারেনা তারা থেমে যায় আর যারা চলতে পারে তারা এগিয়ে যায় | আর এটাই বাস্তবতা | ২ কবি বলেছিলেন “কত রূপ স্নেহ করি দেশীয় কুকুর ধরি বিদেশি ঠাকুর ফেলিয়া ” আর জীবনানন্দ বলেছিলেন “আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়. হয়তো বা মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,. হয়তো বা ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে, কুয়াশার বুক ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়।” এরকম একটি গল্পের কথা বলছি | ফরহাদ ও মাজহার দুজনেই একইসঙ্গে দেশের একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলো | দুজনেই তাদের শিক্ষা, গবেষণা ও ছাত্রদের প্রতি অবদানের মাধ্যমে খুব দ্রুত সবার কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পেলো | সবাই তাদের অর্জনে খুশি হলো | তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় গমন করলো | সেখান থেকে দুজনেই পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করলো | এদের মধ্যে ফরহাদ দেশের টানে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলো | তার মধ্যে আরেকটি বিষয় কাজ করছিলো তা হলো যে দেশ তাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে তার প্রতি তার একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে | সে তার বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে বিষয়টি অনুভব করলো | দেশ ও দেশের মানুষকে সেবার মহান ব্রত নিয়ে সে দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলো | একদিন সে কালক্রমে অধ্যাপক হলো | দেশ তার দ্বারা উপকৃত হলো, দেশের গন্ডি পেরিয়ে তার সুখ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়লো | তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সে একদিন জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত হলো | মাজহারের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত | সে দেশের চেয়ে বিদেশকে বেশি প্রাধান্য দিলো | সে বলে বেড়াতে লাগলো “দেশ আমাকে কি দিলো সেটি বড় কথা নয়, আমি দেশকে কি দিলাম সেটি বড়কথা” এটা সে বিশ্বাস করেনা | সে আরো বলতে লাগলো “দেশের কোনো ভবিষৎ নেই | ওখানে গিয়ে কি হবে আমার নিজের স্বার্থটা আগে দেখতে হবে, দেশের আবার স্বার্থ কি |” সে তার মাতৃভূমিকে অবজ্ঞা করলো | কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আর কঠিন | আমেরিকায় প্রথমে সে যার তত্বাবধানে পিএইচডি করেছিল তার একটি দুই বছরের প্রজেক্টে চাকুরী নিলো | প্রজেক্ট শেষ হলে তাকে বলা হলো আজ থেকে তোমার চাকুরী নেই | এরপর মহা বিপদ তার জীবনে নেমে আসলো | সে দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোনো চাকুরী পেলোনা | তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে সে কোনোমতে একটা ট্যাক্সি চালানোর চাকুরী পেলো | সবসময় মার্কিন সরকারের নজরদারির মধ্যে তাকে থাকতে হলো | এতো বড় ডিগ্রী পেয়ে সে মার্কিন সরকারের সন্দেহের মধ্যে পরে গেলো আর সে এখন একজন গাড়ির ড্রাইভার | সে হতাশাগ্রস্ত হলো | সে যে নিজের দেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল সেখানে আবার যোগদান করার আকুতি জানালো | কিন্তু সময় খুব নির্মম যেমন সে একসময় নির্মম ছিল তার দেশের প্রতি আনুগত্যে | একদিন হতাশায় ভূগতে ভূগতে ব্রেন স্ট্রোক করে সে কম বয়সে মারা গেলো | হয়তো এটাই ছিল প্রকৃতির বিচার | তবে এর ভিন্নতাও ঘটতে পারে তবে সেটা হাতেগোনা | এ. পি. জে. আবদুল কালাম আজাদ এমন একজন প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন তাকে কিন্তু আমেরিকার মতো দেশ কিনতে পারেনি | এর কারণ ছিল তার দেশপ্রেম | ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয় | তিনি ভারতের সফল রাষ্ট্রপতি ছিলেন | এ. পি. জে. আবদুল কালাম আজাদ বলেছিলেন “তিনজনই পারেন একটি দেশ বা জাতিকে বদলাতে। তাঁরা হলেন, বাবা, মা ও শিক্ষক।” আমরা শিক্ষকরা কি তা পারছি নাকি দেশের স্বার্থের চেয়ে আমরা ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিদেশ বিভুয়ে পরদেশী পরজীবী হয়ে দিন যাপন করছি | কেননা তিনি বলেছিলেন “যদি সূর্য হতে চাও তবে সূর্যের মতো নিজেকে পোড়াও।” আমরা দেশে থেকে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে একদিন সোনা হতে চাই | ৩ দুজন মানুষ ছিলেন | তারা দুজনেই বাংলাদেশে বাস করতেন | এদের একজন দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতো আর একজন এগুলো অবজ্ঞা করতো | একদিন সকাল বেলা দুজন দুজনের সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছে | সন্তানরা তাদের বাবাদের জিজ্ঞাসা করলো “কেন আজ সবাই বাসন্তী রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলেছে ।” যে বাবা দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতো সে তার সন্তানকে বললো “আজ বসন্ত উৎসব, বসন্তের প্রথম দিন | তাই মনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে সবাই নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে | তিনি গুন্ গুন্ করে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের সেই পরিচিত গান ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়….।’ তিনি উচ্চারণ করলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমীয় বাণীটি ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত’ | ছেলেটি তার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে গর্ববোধ করলো | তার নিজের ঐতিহ্যে সে আনন্দিত হয়ে উঠলো | আর যে বাবাটি দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতোনা সে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারলোনা | সে বললো মনে হয় এরা সবাই নৃত্য শিল্পী কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছে অথবা এরা বিয়ের অনুষ্ঠানে গমন করছে | তার ছেলেটি সংকীর্ন ও ভুল একটা জিনিস সারাজীবন নিজের মধ্যে ধারণ করে নিলো | এখানে শিক্ষণীয় বিষয় গুলো হলো ১ | প্রযুক্তির সাথে যারা চলতে পারে তারাই টিকে থাকে আর যারা চলতে পারেনা তারা থেমে যায়| ২| দেশকে ভালোবাসুন আর দেশপ্রেমিক হতে শিখুন | স্বার্থপরতা ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে কাজ করুন | ৩| নিজের সংস্কৃতিকে চিনুন ও মনের উদারতা তৈরী করুন |