মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, ওই নয় মাস মানুষের যে আতঙ্ক, যে বেদনা, সর্বোপরি ওই সময়ের প্রেক্ষাপট আমরা অবিকল দেখতে পারি, এমন সাহিত্য আমাদের হয়েছে বলে মনে হয় না। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ- এগুলো আমাদের সাহিত্যে এসেছে। তবে এগুলো নিয়ে কোনো মহৎ সাহিত্য এখন পর্যন্ত দেখি না। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও আমাদের দেশে অনেক বড় বড় অভ্যুত্থান হয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, এগুলোও আমাদের সাহিত্যে অনুপস্থিত। অথচ, এখানে অনেক বড় বড় লেখক আছেন যারা বিশ্বমানের সাহিত্য রচনা করেছেন। সেই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান- এসব নিয়ে আরও অনেক বড় বড় কাজ হওয়া দরকার ছিল।

তরুণদের মধ্যে এখন অনেকেই খুব ভালো লিখছেন। অনেক বয়স্ক লেখকের চেয়েও তাদের সচেতন মনে হয়। তাদের পরামর্শ দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না। এটা ক্ষতিকর হতে পারে। অগ্রজরা সাহিত্য সম্পর্কে নিজের ধারণাটাই তরুণদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আসে। আমরা যখন লিখতে এসেছি, তখন নতুন চিন্তা নিয়ে লিখতে শুরু করেছি। আমরা চেয়েছি শামসুর রাহমানের মতো লিখব না, আল মাহমুদের মতো লিখব না। অন্যভাবে কবিতা লিখব। গদ্যভাষা আরেক রকম হবে। রবীন্দ্রনাথের পর যখন কাজী নজরুল ইসলাম এলেন, তারা দুজনে দুই রকমের কবিতা লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে- তারাও তাদের মতো করে আলাদা আলাদা কবিতা লিখেছেন। যে কোনো তরুণের উচিত তার নিজের মতো করে লেখা, যে লেখাটি আগে কেউ লেখেননি। এটাই একজন প্রকৃত কবির কাজ। বড় মাপের কবি আর কারও মতো লিখবে না। তাকে দেখে যেন সবাই অনুকরণ করে। তার কবিতা মানুষকে নতুন স্বাদ দেবে। জীবনানন্দ দাশ যেমন আর কারও মতো লেখেননি। জীবনানন্দ দাশের কবিতা তার সময়ে কেউ নিতে পারেনি। কারণ, তার কবিতা নেওয়ার মতো, বোঝার মতো প্রস্তুতিই ছিল না মানুষের। এখন মনে হয় জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনেক তাজা। আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে তিনি লিখে গেছেন আজকের দিনের কবিতা। একজন তরুণ কবির কাজ হচ্ছে আজ থেকে ৫০ বা ১০০ বছর পরের কবিতা লেখা। এভাবেই কবি পাঠকদের মধ্যে বেঁচে থাকেন।

সারা দেশে কয়েক শ মানুষ লেখেন। প্রকৃত ভালো লেখেন হয়তো ১০-১৫ জন। তেমনি সবাই ভালো পাঠক নয়। কিছু আছেন সাধারণ পাঠক, কিছু আছেন শিক্ষিত পাঠক। শিক্ষিত পাঠকরা সাহিত্যের মানটা বুঝতে পারেন। সাধারণ পাঠকরা হয়তো নির্দিষ্ট কিছু লেখকের বই পড়েন। লেখার ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভাবেন না। শিক্ষিত পাঠকরা সব ধরনের বই পড়েন। লেখার মান বিশ্লেষণ করেন। লেখক কোন জায়গাটায় ভুল করেছেন তা তারা বুঝতে পারেন। তেমনি সব কবি ও কথাসাহিত্যিক নিজের লেখার ব্যাপারে সচেতন নন। কিছু লেখক গড়ে লেখেন। লেখার ভাব আসে তাই লেখেন। কিছু লেখক সব সময় নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যান। বর্তমানে অনেক তরুণ লেখককে বয়স্ক লেখকদের চেয়ে সচেতনভাবে লিখতে দেখা যায়।

আমাদের সাহিত্যটা আরও এগিয়ে যেত যদি অনুবাদে সমৃদ্ধ হতাম। একদিকে অনুবাদ কম হয়েছে, অন্যদিকে যে অনুবাদগুলো হয়েছে সেটাও ভাষাগত কারণে যুগোপযোগী হয়নি। যে ইংরেজি ভাষায় আমাদের সাহিত্য অনুবাদ করা হয়েছে সেই ইংরেজি ভাষা এখন আর বহাল নেই। এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে ইংরেজি ভাষায় ইংরেজি লেখে, কবীর চৌধুরীরা সেই ভাষায় ইংরেজি লিখতেন না। তাদের ভাষা ছিল অনেকটা ব্রিটিশ ইংরেজি যা এখন পুরনো হয়ে গেছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় আমরা এখন কবিতা লিখি না। কবিতার ভাষা বদলে গেছে। এখন নতুন প্রজন্মের যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করছে তারা অনুবাদের দিকে ঝুঁকলে হয়তো আমাদের দেশের সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেতে পারে। আমাদের অনেক বড় বড় লেখক আছেন। বিশ্বমানের অনেক লেখাও হয়েছে। কিছু বই অনুবাদও হয়েছে। শুধু অনুবাদের ভাষার দুর্বলতার কারণে সেটা দেশের বাইরে সমাদৃত হচ্ছে না।

লেখক : ফরিদ কবির

Pin It