নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়। মমতা নামের প্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি, অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন, ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। আজন্ম আমার সাথী তুমি, আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে, তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে আমারই বন্দরে। গলিত কাচের মতো জলে ফাত্না দেখে দেখে রঙিন মাছের আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে কাঁচি দিয়ে নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে সেই কবে আমি হাসিখুশির খেয়া বেয়ে পৌঁছে গেছি রত্নদীপে কম্পাস বিহনে। তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও সে কোন্ বিশাল গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো, আসো কাঠবিড়ালির রূপে, ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে, সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি বার বার কিম্বা টুকটুকে লঙ্কা ঠোঁট টিয়ে হ’য়ে কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়। বিজ্ঞাপন আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা। যুদ্ধের আগুণে, মারীর তাণ্ডবে, প্রবল বর্ষায় কি অনাবৃষ্টিতে, বারবনিতার নূপুর নিক্কনে বনিতার শান্ত বাহুর বন্ধনে, ঘৃণায় ধিক্কারে, নৈরাজ্যের এলো- ধাবাড়ি চিত্কারে, সৃষ্টির ফাল্গুনে হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মিলিত সর্বক্ষণজাগরণে। তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার ? উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে। এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি, এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস ! তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
শামসুর রাহমান
শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে দুই বাংলায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত। তিনি একজন নাগরিক কবি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয়। তিনি মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) ছদ্মনামে লিখতেন। শামসুর রাহমানের ডাকনাম বাচ্চু, জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা পুরনো ঢাকার মাহুতটুলি এলাকায় নানাবাড়িতে। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। কবি শামসুর রাহমান ১৩ জন ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন ৪র্থ। ১৯৪৫ সালে পুরনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাস করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। ১৯৫৩ সালে পাস কোর্সে বিএ পাশ করে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কেবল বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিংশ শতকের শেষার্ধে তুলনীয় কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বলে ধারণা করা হয়। আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯-এ, এবং তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন। সে গুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয় যা দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব।
শামসুর রাহমান এর সর্বশেষ লেখা
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.