১ শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে; মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয়; বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময় চারিদিকে এখন সকাল— রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল; মাঠের ঘাসের ’পরে শৈশবের ঘ্রাণ— পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান। চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল; প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে, যেই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর, চারিদিকে ছায়া—রোদ—খুদ—কুঁড়ো—কার্তিকের ভিড়; চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হ’তেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার— শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে; আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস; মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়। গাছের ছায়ার তলে মদ ল’য়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিলো ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য—জয়—সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিলো তুলে নেবো তার শীতলতা; ডেকে নেবো আইবুড়ো পাড়াগাঁর মেয়েদের সব; মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে— শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব। হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে—রঙে তার—স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয়; দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ–অবসাদ– আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত। তখন শস্যের গন্ধ ফুরাযে গিয়েছে খেতে—রোদ গেছে প’ড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধ’রে; তখন গিয়েছে থেমে ওই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়; হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালীর বিছানার ’পর; মদের ফোঁটার শেষ হ’য়ে গেছে এ-মাঠের মাটির ভিতর , তখন সবুজ ঘাস হ’য়ে গেছে শাদা সব, হ’যে গেছে আকাশ ধবল, চ'লে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদেব দল। ২ পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে এসেছে বাহির হ’য়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের ’পরে; সবুজ ধানের নিচে—মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চ’লে গেছে; আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা; শস্যের খেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা। ফলন্ত মাঠের ’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন; ফসল—ধানের ফলে যাহাদের মন ভ'রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা ক’রে গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন— আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়— যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটিব নিচে পৃথিবীর তলে; কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায়নি তাদের সময়, পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তা’রা করে নাই ভয়, প্রণয়ীর মতো তা’রা ছেঁড়েনি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেযেদের নামে; চাষীদের মতো তা’রা ক্লান্ত হ’যে কপালের ঘামে কাটায়নি—কাটায়নি কাল; অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে, যোদ্ধা—জয়ী—বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে—পাশাপাশি— জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি! অনেক রাতের আগে এসে তা’রা চ'লে গেছে—তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়— আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা—জানে তাহা নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে-সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধ’রে যায় ডেকে-ডেকে। মাটির নিচের থেকে তা’রা মৃতের মাথার স্বপ্নে ন'ড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভূত ইশারা! আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে— আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে। সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর—বন্দর—বস্তি—কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই খেতে; শরীরের অবসাদ–হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে। শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধ’রে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে অামাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি—পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন জমি উপ্ড়ায়ে ফেলে চ’লে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার প’ড়ে আছে—পুরানো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে— দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে যায় চাঁদ; অবসর অাছে তার—অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চ’লে যাবে পশ্চিমের পানে, এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে। ৩ ফুরোনো খেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নেই, কোনো কৃষকের মতো দরকার নেই দূরে মাঠে গিয়ে আর; রোধ—অবরোধ—ক্লেশ—কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়, জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্খানে— কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়; আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং; দামামা থামায়ে ফেল—পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক্ রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ। এখানে নাহিকো কাজ—উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকে ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়। সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন— জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে। এখানে চকিত হ’তে হবেনাকো, ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই—এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়; এইখানে কাজ এসে জমেনাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে; এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর, রাখিবে না চোখ আর নয়নের ’পর; ভালোবাসা আসিবে না— জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর। অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে
জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ - ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল, ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে 'নির্জনতম কবি' বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি।
জীবনানন্দ দাশ এর সর্বশেষ লেখা
2 মন্তব্য
- মন্তব্যের লিঙ্ক বৃহষ্পতিবার, 25 এপ্রিল 2024 02:20 লিখেছেন Pedrohic
pharmacies in mexico that ship to usa: cheapest mexico drugs - mexican mail order pharmacies
- মন্তব্যের লিঙ্ক সোমবার, 03 জুলাই 2023 23:40 লিখেছেন yrmtqYsl
Regulation of Adipose Tissue Pyruvate Dehydrogenase by Insulin and Other Hormones woman take viagra PMID 35761157 Review
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.