টোকাই হামিদুল, বয়স দশ, নাই তার একূল ওকূল। রাস্তায় রাস্তায় ফেলনা কুড়ায়, বড়লোকের গাড়ি দেখলে দৌড়ে যায়, হাত পাতে, ভিক্ষা চায়--- "ছার মা বাপ নাই, দুইডা টেকা দিবেন? দুইদিন পেডে ভাত নাই। " ঐ চৌরাস্তার মাথায় ওভারব্রীজটার নীচে ঘুমায়। আজ শুক্রবার, দেরি করে ঘুম ভাঙ্গলো তার, আড়মোড়া ভাঙ্গতেই বুকের হাড়হাভাতে পাঁজরের হাড়গুলি ভেসে উঠে নৌকার ছইয়ের ফলার মতো, চরম দারিদ্র্যের উপহাসে। হেমন্ত কাল, চারিদিকে কুয়াশার চাদর,হালকা শীত। কাল দিদিমণি একটা নতুন কম্বল দিয়ে গেছে। সেই দিদিমণি যে প্রতিদিন ব্রীজের উপর দিয়ে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যায়। ছেলে তার হামিদুলের বয়সী, সুন্দর কোমল চেহারা, ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে হামিদুলের। হাত বাড়ায়, আবার গুটিয়ে নেয় নিজের ভেতর, শীর্ণ, কালো, ময়লা হাত দুটি বড়ই বেমানান লাগে। দিদিমণি আসা-যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে দশপাঁচ টাকা দিয়ে যায়, বলে-"কিরে? কেমন আছিস?" অন্যের তুই-তোকারি হমিদুলের ভালো লাগে না। দিদিমণি বললে মায়ের মতো লাগে। খুব ইচ্ছে করে মা বলে ডাক দিতে। পাগলি মা'টা মরেছে পাঁচ বছর আগে, বাপতো চোখেই দেখেনি। কোন বেজন্মা তারে জন্ম দিয়ে রাস্তায় ফেলে গেছে, কোন নরপশুর কুৎসিত লালসার ফসল সে তা কি আর জানে সে? পাঁচ বছর আগে এই ব্রীজের নীচে মরে পড়েছিল পাগলি মা'টা। লাশবাহী গাড়ি এসে নিয়ে গেল তারে। গাড়ির পিছনে ছুটতে ছুটতে গিয়েছিল পাঁচ বছরের হামিদুল। মা আর ফিরে এলো না। সেই থেকে এই ব্রীজের নীচে তার ঘর গৃহস্থালি। মাঝে মাঝে পুলিশ এসে হানা দেয়, চাঁদা চায়,না দিলে তাড়িয়ে দেয়। বখাটেরা উৎপাত করে,টাকা কেড়ে নেয়। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে কাঁপে, রাতের বেলায় চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখে ব্রীজের ফাঁক গলিয়ে চাঁদ উঠে, হমিদুলের বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠে। সঙ্গী তার রাস্তার নেড়ি কুকুর কালু। এক বিছানায় ঘুমায়, একটা পাউরুটি ভাগ করে খায়। মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, আকাশের দিকে মুখ করে চিৎকার করে কাঁদে --- মা--- মা তুই কই গেলি? মা--- কালু তাকে সঙ্গ দেয়,আকাশের দিকে মুখ করে ঘেউ ঘেউ করে। হামিদুলের আরেক বন্ধু মন্টু। পাশের বস্তিতে থাকে, দুজন মিলে ফেলনা কুড়ায়, মাঝে মাঝে সিগারেট কিনে খায়। ওভারব্রীজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয় ---"ভাইয়েরা আমার ---।" বক্তৃতাগুলি মুখস্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ওদের জনসভা, মিছিলে নিয়ে যাওয়া হয় ভাড়া করে, এক প্যাকেট বিরিয়ানি কিংবা পঞ্চাশ টাকায়। পুলিশের দৌড় আর লাঠি খায়। হামিদুল পড়তে জানে না কিন্তু টাকার হিসাব জানে। প্রতিদিন কিছু করে টাকা জমায় ভেনওয়ালা ছলিম চাচার কাছে। স্বপ্ন দেখে, সে একদিন অনেক বড় হবে, মস্ত বড় বাড়ি, মস্ত বড় গাড়ি! বড়লোকের গাড়ির পিছনের সিটে বসে থাকা সুন্দর চোখের যে রাজকন্যা সে প্রতিদিন দেখে, একদিন সে তার হবে। ঠিক পাগলি মায়ের গল্পের রাজকন্যার মতো। একদিন সে এই শহরটা কিনে নিবে, উপরের ঐ আকাশটাও। যেখানে তার পাগলি মায়ের নিত্য বসবাস। হমিদুল হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখে বারবার অভিজ্ঞ নিপূণ চোখে। ঘড়িটা ভাঙ্গারি চাচার দোকান থেকে দশ টাকা দিয়ে কেনা, পুরাতন, নষ্ট। হমিদুলের ঘড়ির কাঁটা ঘুরে না, তার জীবন চাকা ঠিকই ঘুরে, অতি কষ্টে লাঞ্ছনায়,বঞ্চনায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করতে করতে। ....….................…..................................
শেয়ার করুন
প্রকাশিত বিভাগ কবিতা

রহিমা আক্তার লিলি
রহিমা আক্তার লিলি নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার তাতারদী গ্রামে ১২ নভেম্বর ১৯৭৭ সনে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ তরেন। তাঁর পিতা মোঃ আব্দুর রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাতা মোছাঃ আম্বিয়া রহমান। তিনি তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সকলের বড়। তাঁর স্বামী মোঃ মিজানুর রহমান তিনি পেশায় একজন তড়িৎ প্রকৌশলী। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক মন্তানের জননী নাম মারসাদ সাফওয়ান। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষিকা ছিলেন তবে বর্তমানে একজন আদর্শ গৃহিণী। বই পড়ার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন।
রহিমা আক্তার লিলি এর সর্বশেষ লেখা
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.