শনিবার, 11 জুন 2016 11:21

চন্দ্রা নির্বাচিত

লিখেছেন
লেখায় ভোট দিন
(6 টি ভোট)
                ১
হাল্কা এক পশলা বৃষ্টি হয়েই চলছে সেই এক ঘন্টা ধরে। গ্রামের মাটির রাস্তা চটচটে কাঁদা মাখা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। আর সেই কাঁদা মাখা পথে একদল খুঁদে ম্যারাডোনার দল একটা ফুটবল নিয়ে যত্রতত্র হানাহানি করে বেড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আর কিই বা হবে, রাস্তাটি অসহায়ের মত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে সে তার সেই চটচটে কাঁদা দিয়ে ম্যারাডোনার দলকে চমৎকার সাঁজে সাঁজিয়ে তুলচ্ছে। খুব ভাল করেও দেখে বলার উপায় নেই যে কোনটি কার ছেলে। এক একজন যেন এক একটি মুর্তিতে রুপান্তরিত হয়ে গেছে। রাস্তায় এই রকম বাধার সম্মুখিন হয়ে নরেন্দ্র বারুর্যে খেপে গেলন। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিল, এই বেয়াদপের দল, তোরা কি আর মাঠ-ঘাট পাস নি? মরতে এই রাস্তাতেই আসতে হল। থাম বলছি, থাম। আমার গায়ে যদি এতটুকুও কাঁদা লাগে তবে তোদের চৈদ্দোগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বো। হঠাৎ করে জমিদারের নায়েব কে আসতে দেখে আর তার বাঘের মত গর্জন শুনে সকলেই হকচিয়ে গেল। খেলা ছেড়ে রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে দাড়ালো। আর নরেন্দ্র মোটা-মুটি নিজেকে তুলে নিয়ে কোন মতে ঐ নোংরা জায়গাটাকে পার হল। মাথায় ছাতি, ভাজ না ভাংগা একটা নূতন ফতুয়া পড়েছে নরেন্দ্র। জরির পাড় দেয়া সদ্য কাচা ধুতিটা কাঁদায় ভয়ে এতটাই তুলে হাটছে তাতে অনেকেই তার দিকে লজ্জায় তাকাতে চাইবে না। কিছুটা পথ এগোনোর পরেই রাস্তাটি পশ্চিমে বাক নিয়ে সোজা জমিদার বাড়ি দিকে চলে গেছে। আর নরেন্দ্র সেই দিকেই যাচ্ছে।
সকালেই জমিদারের পেয়াদা বাড়িতে এসে খবর দিয়ে গেছে যে জরুরী দরকার আছে। তাই নরেন্দ্র হাট থেকে ফিরে এই ঝড়-বাদল মাথায় নিয়ে সোজা ছুটেছে জমিদার বাড়ির দিকে। রাস্তাটা যেখানে পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে তার গা ঘেসে একটা খোলা উচু জমি রয়েছে। তার একধারে একদল মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে নরেন্দ্র সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নরেন্দ্র অবাক, এরা কারা? গতকালও তো এখানে কেউ ছিল না। কোন লোকজন সচার-আচার এই জমিতে আসে না। তাই এই জায়গার নাম দিয়েছে ভুতের ভিটা। নরেন্দ্রর একমনে ইচ্ছা হচ্ছিল তাদের কে ডেকে জিজ্ঞাসা করে যে এরা কারা, আবার ভাবলো বৃষ্টির শব্দ, এখান থেকে ডাক দিলে ওরা শুনতে পাবে না। আবার কাঁদা মারিয়ে ওদের কাছে যাবার কোন ইচ্ছা নেই। বিশেষত যখন এই সাহেবী পোষাকে জমিদারের বাড়ি যাবার জন্য বেড় হয়েছে। তাই ঐ দিকে পড়ে দৃষ্টি দেবে এই চিন্তা করে জমিদার বাড়ির দিকেই রওনা হল। 
সদর দরজার পাশে কুয়ার জলে হাত-পা ধুয়ে নরেন্দ্র বৈঠক খানার দিকে গেল। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো এরই মধ্যে সবাই চলে এসেছে। জমিদারের সামনে গিয়ে একটা প্রমাণ জানিয়ে। নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। 
জমিদার বলল, কি হে নরেন্দ্র আজ যে বড় সেঁজে গুঁজে এসেছো? 
না মানে জমিদার মশাই, গঞ্জ থেকে সোজা আপনার এখানে চলে এলাম, তাই আর কি। মাথা নামিয়ে একটু মিষ্টি হাসি ঠোটে লাগালো নগেন্দ্র। 
নগেন্দ্রর বয়স প্রায় ৫৫ হবে তবে এতটাই শক্তসামর্থ দেহের গঠন যে, একটু অবাকই হতে হয়। তবে নিজের দেহে যৌবনকে ধরে রাখতে পারলেও নগেন্দ্রর মোটামুটি সব চুলই সাদা হয়ে গেছে। একটা প্রচোলিত কথা আছে যে, পক্ক কেশ জ্ঞানের লক্ষন। এই কথা নগেন্দ্রর জীবনের চুড়ান্ত ভাবে সত্য প্রমানিত হয়েছে। এই জমিদারীরতে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার উপরে জমিদার চোখ বুজে নির্ভর করে। এক কথায় তিনিই এখন জমিদারী পরিচালনা করছেন। তাই কোন বিষয়ে নরেন্দ্রর সম্মতি পেলে জমিদার আর কারও মতামতের তেমন গুরুত্ব দেয় না। তাই নরেন্দ্রর উপস্থিতি জমিদারকে বিশেষ শান্তি দেয়। আজও তাই হল। নরেন্দ্রকে দেখে জমিদারের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
তাই জমিদার শুরু করলেন কিন্তু একটু রসিকতার সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইলেন না। 
ভাল, নরেন্দ্র একটা জরুরী কথা বলার জন্য তোমাদের সকলকে ডেকেছি। বিষয়টা হচ্ছে, আমাদের জমিদারীর পশ্চিমে নদীর ধারে যে ভুতের ভিটা আছে সেখানে একদল বেদে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সর্দার আজ খুব সকালে আমার কাছে এসেছিলো। তারা এখানে থাকতে চায়। আমি একা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, তাই তোমাদেরকে এই কষ্ট দেয়া। এই বিষয়ে তোমরা তোমাদের মতামত দিতে পার। 
একে একে সকলে তাদের মতামত দিতে থাকলো কিন্তু নরেন্দ্র কেমন জানি একটু চিন্তাতে বিভোর হয়ে গেল। সে আসার পথে ঐ বেদের বস্তিটাকে দেখছে, আর এখন তাদের কথাই ভাবছে। এরা কারা? কোথা থেকে এসেছে? 
কি হে নরেন্দ্র তুমি কি অসুস্থ নাকি? কি ভাবছো? হঠাৎ জমিদারের কন্ঠস্বরে নরেন্দ্রর স্বস্তিতে ফিরলো। 
বলল, না, না মানে, আমি ওদের কথাই ভাবছিলাম। আসার পথে ওদের বস্তিটা দেখলাম তো তাই। তা বেশ, ভাল কথা। আমি বলল, জমিদার মশাই, আমরা মনে হয় তাদের থাকে দিতে পারি। তারা থাকুক। জমিটাতো আমাদের পরেই থাকে। কোন কাজে আসে না। তারা যদি থাকতে চায় থাকুক তবে ওদের বলতে হবে যে, কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন না হয়। শান্তিতে যদি তারা থাকতে পারে তবে থাকুক। 
নরেন্দ্রর কথা শুনে জমিদারও মনে স্বস্তি পেল। তিনিও চাচ্ছিলেন যেন বেদেরা ওখানে থাকে। তবে সকলের পরামর্শ একটু নেয়ার দরকার ছিল। বিশেষ করে নরেন্দ্রর। তাই তিনি বললেন, ঠিক আছে তোমরা সকলেই যেহেতু তাদের থাকার ব্যাপারে মত দিচ্ছো তবে তারা থাকুক। কালই আমি সর্দারকে ডেকে আজকের সিদ্ধান্ত তাদের জানিয়ে দেবো। আর একটু সাবধানও করে দেব যেন গন্ডগোল না করে। 
পরের দিন লোক পাঠিয়ে জমিদার সর্দারকে ডেকে আনলেন। জমিদারের কাছারি ঘরে বৈঠক বসেছে। জমিদার সর্দারকে জানিয়ে দিলেন যে, আপনারা থাকতে পারেন তবে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন আপনাদের দ্বারা না হয় । এই বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। যদি কোন কোন ধরনের নালিশ হয় আর আপনারা যদি দোষী হন তবে আপনাদের এই জমিদারী ছেড়ে চলে যেতে হবে।
জমিদারকে সালাম জানিয়ে সর্দার এই আনন্দের সংবাদ নিয়ে বস্তিতে উপস্থিত হলেন। সারা বস্তিতে যেন আনন্দের সারা পরে গেল। আজ বেদে বস্তিতে সত্যিকারের ঈদ উপস্থিত হয়েছে। আজ তারা একটি স্থায়ী থাকার জায়গা পেল। তাদের ছেলে-মেয়েরা এখন পড়াশুনা করতে পারবে। তাদের সুন্দর ভবিষ্যত হবে। এই আনন্দে সকলে আত্মহারা হয়ে গেল। দিনের পর দিন ধরে নৌকায় ভেসে ভেসে তাদের দিন কেটেছে। কোথাও এত টুকু সময়ের জন্য তারা আশ্রয় পায় নি যাদের কাছেই আশ্রয় চেয়েছে তারাই কুকুরের মত করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বেদেরা যেন মানুষই না। কোন সমাজের লোকেরা তাদের সঙ্গে মেশে না। তাদের সংগে কোন আত্মিয়তা করে না। কোন কাজে নেয় না। এই রকমের পশুর জীবন ছিল তাদের। কিন্তু এই ভিন জাতির জমিদার কত সহজেই তাদেরকে আশ্রয় দিল। সত্যি কত বড় মনের মানুষ এই জমিদার। নিজের অজান্তেই মাথা নত করে জমিদারকে শত সালাম জানালো সর্দার। 
সব মিলিয়ে এই দলে প্রায় ২৬ টি পরিবার আছে। চার স্ত্রী নিয়ে জমিদারের পরিবার। ১২ ছেলে আর এক মেয়ে। সব ছেলেরাই বিয়ে করে নিজ নিজ ঘর আলাদা করেছে। মেয়েটি সবার ছোট। তার নাম চন্দ্রা। চাঁদের মতই তার রুপ। দুধে আলতা গায়ের রং। মাঝারি গড়ন। শরীরের চড়াই-উৎরাইগুলি তার রুপের আগুনকে বাড়িয়ে দ্বিগুন করেছে। তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। এই গরীবের ঘরে এত রুপ যেন নর্দমার জলে চাঁদের ছায়া। গরীবের রুপ প্রায়শই বিপদের কারণ হয়। তার তাই চন্দ্রা কখনও বস্তির বাইরে যেত না। সব সময় বস্তির কুঁড়েতে দিন কাটাতো। কখনও কখনও সে একটু বাইরে এলেও তাদের সীমানার বাইরে কখনই যায় নি। 
এভাবে থাকতে থাকতে চন্দ্রার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাই সে সর্দারকে বলল, আব্বা, আমাকে কি একবার তোমার সাথে হাটে নিয়ে যাবে। আমি শুধু যেয়েই তোমার সাথে চলে আসবো। 
মেয়ের দিকে তাকিয়ে সর্দার আর না বলতে পারলো না। তাই সঙ্গে নিয়েই রওনা হল। তবে ধর্মের নিয়ম মত নিজের যৌবনকে আড়াল করতে এতটুকু অবহেলা করেনি চন্দ্রা তবে দারিদ্রের সামর্থে যতটুকু করা যায় আর কি। মাথা নিচু করে বাবার সাথে সাথে চন্দ্রা রওনা হয়েছে হাটের পথে। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চন্দ্রা হাঁটছে। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে নতুন নতুন মানুষগুলোর মুখ দেখার লোভ সে সামলাতে পারে নি। কত রকমের মানুষ। কত তাদের চেহারা। এভাবে তারা হাটে এসে উপস্থিত হল। যখন তারা হাঁটে ঢুকবে এমন সময় হালকা একটু বাতাসে চন্দ্রার মুখের উপরের কাপড়খানি একটু সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গতিতে আবার তা ঠিক করে নিল। কিন্তু ঠিক করেই যখন পাশে মাথা তুললো দেখলো রাস্তার ওপারে একটি যুবক তারে দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রা কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে বাবার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে চলে গেল। আর সাহস হল না একবার মাথা তুলে পিছনে তাকিয়ে ঐ ছেলেটাকে একবার দেখে। 
এদিকে জমিদার পুত্র নিখিল ঠায় সেখানে দাড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই বন্ধুরা ধাক্কা দিয়ে বলল, এই নিখিল কি হয়েছে? কি দেখছিস ও দিকে তাকিয়ে?
বন্ধুদের কথায় নিখিল একটু কেঁপে উঠলো। প্রকৃত ঘটনা লুকানোর জন্য নিখিল বলল, না না কিছু না। এমনিই, হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা এল তাই ভাবছিলাম। চল, সন্ধ্যা হয়ে এলো বড়ির দিকে যাই। 
বন্ধুরা বলল, হ্যাঁ চল, চল। সবাই বাড়ির দিকে রওনা হল। কিছু দুরে এগিয়ে নিখিল আবার পিছনের দিকে তাকিয়ে একটু দাঁড়ালো। একবার ভাবলো, একটু অপেক্ষা করি। ও নিশ্চই ফিরে আসবে। আবার ভাবলো, দাঁড়ালে বন্ধুদের কি জবাব দেবে। 
এই নিখিল, আবার দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আয়। কারও জন্য অপেক্ষা করছিল নাকি?
না না, এমনি চল চল।
সারা রাস্তাতে নিখিল অন্যমনষ্ক ভাবে হাটলো, ও যেন নেশা করেছে। সত্যিই তো এ তো নেশাই। কি অপরুপ সেই মুখ। সেই ঠোট। সেই ভয়ে কাতর চোখ। এরচেয়ে অধিক আর কোন নেশা আছে। ঐ হাঁটা, নিজেকে লুকানো। একটি একটি করে সব ছবিগুলি নিখিলের চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলো আর নিখিল একটু করে উত্তেজিত হতে থাকলো। সারা রাত নিখিল ঘুমাতে পাড়ে নি। কে ঐ মেয়ে। কোথা থেকে এসেছে। কেন নিজেকে ঐভাবে লুকিয়ে চলছিল। বিছানাতে এপাশ ও পাশ করতে করতে সূর্যের আলো ফুটে উঠলো। হাত মুখ ধুয়ে কোন মতে কিছু মুখে দিয়ে আবার সেই রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। সকাল যায় দুপুর যায় কিন্তু তার কোন দেখা নাই। এদিকে তাকে একটু দেখতে না পারলে মনে হয় নিখিল পাগল হয়ে যাবে। বিকাল হয়ে গেল তবুও নিখিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না। তাই সব বন্ধুদের ডেকে সব কিছু তাদের বলল। 
আমি ওকে ছাড়া আর স্থির থাকতে পারছি না। তোরা আমাকে একটু সাহায্য কর। আমার চোখে সেই আগুনের নেশা ছেয়ে গেছে। আমি ঐ আগুনে একটু ঝাপ দিতে চাই। আমি ওকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। তোর খোঁজ নে।
আমরা কিভাবে তাকে খুঁজে বের করবো? আমরা তো তাকে দেখিই নি। জানিই না কাকে খোঁজ করব। 
দেখ, আমি জানি না যে ও কে, তবে এতটুকু আমি জানি ওকে আমার দরকার। আমি জানি না ও কোথায় থাকে, কোথা থেকে এসেছে আর কোথায় চলে গেছে কিন্তু ওকে আমার চাই। যেভাবেই হোক ওকে খুঁজে বেড় কর। 
তাকে খোঁজার জন্য অত্যন্ত একটা সূত্র দরকার; আমরা কোন সূত্র ধরে খুঁজবো?
অনেক ভেবে চিন্তে নিখিল বলল, সূত্র একটা হতে পারে!
কি, কি? আগ্রহ নিয়ে বন্ধুরা তার দিকে তাকালো।
মানে ও যে পোশাক পড়া ছিল তা আমাদের সমাজে কেউ পড়ে না। কাপড় দিয়ে নিজেকে একেবারে ঢেকে রেখেছিল। ও চেহারা বা শরীর কোনটাই দেখার কোন সুযোগ ছিল না। 
তাহলে, তুই যে বললি তুই ওর রুপ দেখে পাগল হয়ে গেছিস?
বাতাসে ওর মুখের কাপড় একটু সরে গিয়েছিল আর আমি শুধু মাত্র ওর মুখ, ওর ঠোট দেখতে পেয়েছিলাম। এই এক মূহুর্তের জন্য। আর আমার পৃথিবী সেখানে থেমে গিয়েছিল। আমি ওকে চাই যেভাবেই হোক। 
ঠিক আছে আমরা চেষ্টা করছি, তবে ভাল পুরষ্কার দিতে হবে।
চিন্তা করিস না, যা চাইবি তাই দেব; তোরা শুধু ওকে আমার কাছে এনে দে। 
সারা রাত আবার সেই ছটফট। বিছানার এপাশ থেকে ও পাশ। কখন সকাল হবে আর বন্ধুর তার খবর নিয়ে আসবে। আজকের রাতটা যেন একটু বেশিই বড় হয়ে গেল। সময় যেন এগোচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে নিখিল বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। রাতের আকাশে তারা গুলো যেন নকশি কাঁথার ছবি। চাঁদের আলোতে যেন ঐ একটি চেহারাই দেখা যাচ্ছে। যেদিকে তাকায় সেদিকে সেই ভয়ে কাতর একটি মুখ। নিখিল পাগল হয়ে যাবে। নিজের মাথার চুলগেুলো টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল নিখিল। সব বন্ধুদের এক জায়গায় করে নির্দেশনা দিয়ে চারিদিকে পাঠিয়ে দিল। আর নিজে সকলের অপেক্ষায় তাদের আড্ডার জায়গায় বসে রইলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল আর দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল তবুও এখনও পর্যন্ত কেউ কোন খবর নিয়ে ফিরে এলো না। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়ে এলো। নিখিল আর অপেক্ষা করতে পারছে না। কি করবে সে। আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হল। হঠাৎ পথের মধ্যে একে একে সব বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। কেউ কোন খবর দিতে পারলো না। নিরাশ মনে বাড়ির পথে এগোলো। 
২
আজ রাতেও একই ভাবে নিখিল ঘুমাতে পারলো না। কোন মতে নিজেকে বিছানার সঙ্গে আটকে রাখলো। আর ভাবছে, আর কি কোন দিন দেখা হবে না। একটু একটু করে সময় এগিয়ে চলল আর সকাল হল কিন্তু আজ আর বাইরে যেতে মন চাচ্ছে না। নিজের ঘরেই বসে রইলো। মা অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছে, শরীর অসুস্থ কিনা, কি বলবে নিখিল; ওর শরীর তো ঠিকই আছে কিন্তু ওর মনটা দিনে দিনে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। কোন কিছু খেতে ভাল লাগছে না। উদাস ভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুরের আকাশ দেখছে এমন সময় ওর বন্ধু গনেশ এসে দাঁড়ালো। 
কোন সংবাদ আছে গনেশ? 
মাথা নিচু করে গনেশ দাড়িয়ে আছে। কোন কথা বলছে না।
কি হল কথা বলছিস না কেন? ওকে খুঁজে পাস নি? কথা বল।
গনেশ মাথা জাগালো। 
খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু .....
কিন্তু! কি হয়েছে?
ওরা মুসলমান, ও বেদে সর্দারের মেয়ে। ভুতের ভিটায় ওরা আশ্রয় নিয়েছে।
নিখিল যেন থমকে গেল, নিরব হয়ে গেল। কিন্তু ওকে আমার চাই যে ভাবেই হোক। 
গনেশ, একবারের জন্য হলেও ওকে আমি দেখতে চাই। আমি ওকে স্পর্শ করতে চাই। তুই ব্যবস্থা কর। তুই আমার বন্ধু না, প্লিজ..
কিন্তু তোর বাবা জানতে পারলে?
জানতে পারবে না। আমরা অন্য জায়গায় নিয়ে যাব।
ঠিক আছে....। এই বলে তারা দুজনে একটা প্লান তৈরি করলো। 
তুই রেডি থাকিস, আমি আসছি। 
আয়, আমি ঠিক সময়ে প্রস্তুত থাকবো।
আর সেই রাতে বন্ধুদের নিয়ে নিখিল বেদে বস্তির পাশে গোপনে অপেক্ষা করতে থাকলো। রাতে যখন চন্দ্রা বাথরুমের যাবার জন্য বের হল, সেই সুযোগে ওরা চন্দ্রার মুখ বেঁধে নৌকায় করে নদীর ওপাড়ে নিয়ে রওনা হল। চন্দ্রা চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু ওর ভিতর থেকে কোন স্বর বেড় হচ্ছিল না। ও বুঝতে পারলো কাপড় দিয়ে ওর মুখ বাধা রয়েছে। হাত-পাও বাধা। ভয়ে চন্দ্রার হৃদয়টা শুকিয়ে আসছে। ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। কারা এরা, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। কি করবে ওকে নিয়ে? এমন সময় নৌকা পাড়ে এসে লাগলো। ধরাধরি করে ওরা চন্দ্রাকে নিচে নামালো আর প্রায় কাঁধে করে নিয়ে একটা আধ ভাঙ্গা পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে আসলো। 
নে তুই মস্তি কর, আমরা দুরে দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছি। এই বলে বন্ধুরা সকলে দুরে চলে গেল।
নিখিল কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ও ভাবছে। এই মেয়েটাকে আমি ভালবেসে ছিলাম কিন্তু ও তো বেদে ঘরের মেয়ে, আর মুসলমান; আমার পরিবার, আমার সমাজ কেউ মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু ওর রুপ, ওর যৌবন, ওর শরীর নিখিলকে পাগল করে তুলেছে। ভালবাসার জলে নিখিল ওর শরীরে কামনার আগুনকে নেভাতে চাইছে কিন্তু ও পুরুষত্ব, ওর মনে বন্যতা বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত চন্দ্রার উপরে ঝাপিয়ে পড়তে চাইছে। এভাবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নিখিলের শরীরের বন্যতা জয় লাভ করল। আর ও চন্দ্রার উপরে হায়নার মত ঝাপিয়ে পড়ল। যেভাবে শিকারী ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের উপরে। একটু একটু করে ও যেন ছিরে খেলো চন্দ্রার শরীর। এটাই ভালবাসা। এটাই সুখ। ক্ষত বিক্ষত যন্ত্রনায় কাতর চন্দ্রার চিৎকার যেন দু হাত দুর থেকেও শোনা যাচ্ছে না। বাঁচার জন্য আর্তনাদ নিখিলের বন্য খুশিকে যেন আর জাগিয়ে তুললো। অবশেষে এক সময় ক্লান্ত হয়ে নিখিল চন্দ্রাকে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো আর নিজের মনে এক সুখের, পরিতৃপ্ততার হাসি হাসতে লাগলো। আমি পেরেছি। আমি ওকে পেয়েছি। আমি ওকে ভোগ করেছি, ঐ শরীর আমাকে তৃপ্ত করেছে। নিখিল হাঁসছে। বন্ধুরা ফিরে এসে চন্দ্রার ঐ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল।
নিখিল, এই নিখিল কি করেছিস। মেরে ফেরলি নাকি। গনেশ দৌড়ে গিয়ে চন্দ্রার নাকে নিজের হাত রেখে তার শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে চাইলো। চিৎকার করে বলল, বেঁচে আছে, চল ওকে ওদের বস্তির কাছে রেখে আসি। যা হবার ওখানে হোক, চল। এই বলে আবার তারা চন্দ্রার নিঁথর দেহটাকে নৌকায় ওঠালো। ধীরে ধীরে তারা আবার এপাড়ের কাছে আসলো। দেখলো লোকেরা আলো জ্বালিয়ে চন্দ্রার খোঁজ করছে। তারা নৌকা নিয়ে একটু দুরে ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করলো আর লোকেরা যখন খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে বস্তির দিকে চলে গেল তখন তারা চন্দ্রার দেহটাকে বস্তির কাছে নদীর তীরে ফেলে রেখে চলে গেল। 
চারিদিকে পাক-পাখালি ডাকছে। ভোড়ের নামাজের জন্য লোকেরা উঠতে শুরু করেছে। চারিদিকে হাল্কা আলোর লুকোচুরি। সর্দারও চাইছে যেন সে উঠে নামাজের জন্য ওজু করে কিন্তু আজ আর তার শরীর তাকে সাহায্য করছে না। সারা শরীরে যেন রাজ্যের বোঝা এসে চেপেছে। শরীরটা যেন পাথর হয়ে গেছে আর একটা চিন চিন ব্যাথা তাকে মেরে ফেলতে চাইছে। হে আল্লাহ বলে সর্দার জোড়ে জোড়ে কেঁদে উঠলো। চন্দ্রা এখনও ঘরে ফেরেনি। কি হয়েছে তার কেউ বলতে পারে না। নিজের হাতে নিজের মুখটা চেপে ধরে সর্দার এই লজ্জাময় পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। এমন সময় কিসের যেন একটা কোলাহল তার কানে আসছিল, কোন মতে নিজের ভারটা পায়ের উপরে রেখে বাইরে এসে আধো অন্ধকার আধো আলোতে দেখতে চেষ্টা করল কি হয়েছে; এমন সময় একজন দৌড়ে এসে বলল, সর্দার চন্দ্রাকে পাওয়া গেছে। 
কোথায়? আমার মেয়ে কোথায়.... বলতে বলতে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় নদীর দিকে দৌড় দিল। ইতিমধ্যে কয়েকজন মহিলারা চন্দ্রার যত্ন নেয়া শুরু করেছে আর করেয়জন পুরুষ দাড়িয়ে আছে। সর্দারকে আসতে দেখে তারা কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিল। সর্দার মেয়ের মাথাটা নিজের কোলের উপরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করতে থাকলো.
চন্দ্রা, মা আমার কথা বল, একটু চোখ খোল, কথা বল। এই আমার মেয়ে কথা বলছে না কেন, এই তোমরা কিছু বল আমার মেয়ে কথা বলছে না কেন?
এরই মধ্যে কেউ একজন বলল, ডাক্তার আনতে হবে, অমনি সর্দারের বড় ছেলে কাশেম ডাক্তার আনতে দৌড় দিল আর সকলে ধরাধরি করে চন্দ্রাকে ঘরে নিয়ে আসলো। শরীর থেকে ময়লা-মাটি, রক্ত পরিষ্কার করে তাকে পরিষ্কার কাপড় পরাল। এর মধ্যে চন্দ্রা একবার চোখ খুলেছে। পানি, পানি বলে আর্তনাদও করেছে। চন্দ্রা একে একে সকলের দিকে তাকাতে থাকলো। চোখ ঘুড়িয়ে যখন বাবার দিকে তাকালো আর নিজেকে বেধে রাখতে পারলো না। হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। এরই মধ্যে ডাক্তার চলে এসেছে। সবাই একটু সরে গিয়ে ডাক্তারকে জায়গা করে দিল। ডাক্তার যখন সবিশেষ পরীক্ষা করে দেখছেন তখন চারিদিক যেন নিস্তব্দ হয়ে গেল। শুধু মাঝে মাঝে সর্দার চিৎকার করে উঠছে, হে আল্লাহ কেন, কেন তুমি আমার মেয়ের জীবনটা এভাবে নষ্ট হতে দিলে, কি দোষ আমাদের, আমরা গরীব এটাই কি আমাদের অপরাধ? তোমার এ কি বিচার। তার আর্তচিৎকার যেন বর্জপাতের মতো করে পৃথিবীকে চিরে ফেলতে চাইছে। এ যেন এমন এক অভিশাপ তাতে এই আর্তনাদ দোষীদেরকে বিদ্যুতের মত আঘাত হানবে। 
ডাক্তার বললেন, শুনুন, কিছু মনে করবেন না। আপনার মেয়েকে ধর্ষন করা হয়েছে। তাকে শারীরীক ভাবে যথেষ্ট অত্যাচার করা হয়েছে। ও মনের জোড়ে বেঁচে আছে। তবে ও এখন বিপদ মুক্ত। আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি তা নিয়ম মত খাওয়ান। তাতে ও কিছু দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে। তবে ওর সব চেয়ে বড় চিকিৎসা হল ওর যত্ন নেয়া। কোন ভাবে ও যেন কোন বিষয়ে কষ্ট না পায়। ভালবাসা দিয়ে ওর এই দুঃস্বপ্নকে মুছে দিতে হবে। সব সময় ওকে চোখে চোখে রাখবেন যেন ও কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে। আমি পরে এসে আবার দেখে যাব। আর এর মধ্যে যদি কোন ভাল-মন্দ হয় তবে আমাকে জানাবেন। এই বলে ডাক্তার চলে গেলেন। 
৩
ভালবাসা আর যত্নে চন্দ্রা দিনে দিনে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। কিন্তু তার ভিতরের সেই ১৬ বছরের প্রানোজ্জল কিশোরীটি মারা গেছে। এখন আর সে ঘর থেকে বেড় হয় না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করে না, রাতে ঘুমের মধ্যে বার বার কেঁদে ওঠে। ও যেন জীবন নামের একটা বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে শেষ করে দেবার কথা যে ও ভাবে নি এমন নয় কিন্তু ওর বাবার চোখ ওকে সর্বদা ঘিরে রেখেছে। এভাবেই কয়েক দিন কেটে গেল।
একদিন সকালে সর্দার দেখলো কিছু লোকজন তার বস্তির দিকে আসছে। দুর থেকেই বোঝা গেল যে জমিদার তার লোকজন নিয়ে আসছে। সর্দার বুঝে উঠতে পারলো না কি হয়েছে, একে একে বস্তির সবাই সর্দারের পাশে এসে দাড়িয়েছে। জমিদার কাছে আসতেই সর্দার মাথা নত করে সালাম জানালো। একটি চেয়ার জোগার করে জমিদারের বসার ব্যসস্থা করা হল। 
কথা শুরু করলেন নরেন্দ্র, দেখ, সর্দার তোমার মেয়ের প্রতি যা হয়েছে। তার জন্য আমরা দুঃখিত।
কর্তা, আপনারা জেনেছেন, (হাত জোড় করে সর্দার নরেন্দ্রর সামনে হাটু পেতে বসে পড়লো)। কেন এমন হল কর্তা? আমি কি অপরাধ করেছি? আমরা কেউ জানি না কে আমাদের এই সর্বনাশ করল?
জমিদার মাথা নত করে বসে আছে। নরেন্দ্র আবার শুরু করতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই নিখিল দৌড়ে এসে সর্দারের পায়ে পড়ল। 
আমাকে ক্ষমা করে দেন, আমি আপনার মেয়ের এই সর্বনাশ করেছি। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি ওর কাছেও ক্ষমা চাবো। 
সর্দার অবাক হয়ে গেল। তুমি কে? আমরা তোমার কি ক্ষতি করেছি যে তুমি আমাদের এত ক্ষতি করলে? 
বস্তির লোকেরা ধীরে ধীরে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সব দিকে নজর দিয়ে নরেন্দ্র আবার শুরু করল, ওর নাম নিখিল। আমাদের জমিদারের একমাত্র ছেলে।
হঠাৎ করেই সকলেই স্তব্দ হয়ে গেল। এবার জমিদার মুখ খুলল, সর্দার তোমাকে যে কি বলব তা আমি জানি না। আমার ছেলে যে কাজ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। তবে ও খারাপ ছেলে না। ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ও তোমার মেয়েকে ভালবাসে, কিন্তু কি জানি কি হল, ও এই অন্যায়টা করে ফেলেছে। আমরা কিছুই জানতাম না। কিন্তু নিখিল গত পরশু দিন আমার কাছে এসে সব স্বীকার করেছে আর নিজের পাপের প্রায়চিত্ত করতে চেয়েছে। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে আমরা কিছু টাকা-পয়সা ক্ষতিপুরণ দেবো যেন তুমি তোমার মেয়ের ভাল বিয়ে দিতে পারো; কিন্তু নিখিল তাতে রাজি হয় নি। সে বলেছে ও তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। জমিদার নীরব হয়ে গেল। নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে জমিদার আবার বললেন, 
আমি জানি এটা কতটা অসম্ভব। আমার সমাজ, আমার পরিবার, আমার জমিদারী সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যাবে। সমাজে আমার মাথা কাটা যাবে। তাই আমরা এই প্রস্তাবে রাজি ছিলাম না কিন্তু আমি আমার ছেলেকে অনেক ভালবাসি। আমি ওকে হারাতে চাই না। অবশেষে আমাকে রাজি হতে হল। তুমি রাজি থাকলে তোমার মেয়েকে আমার আমার পুত্রবধু করে নিতে চাই। 
বাইরে লোকজনের কথা শুনে চন্দ্রা বেড়ার ফাঁকা দিয়ে বাইরে তাকালো। দেখলো বাইরে অনেক লোকের ভিড় হয়ে গেছে। অল্প অল্প করে সব কথা শুনছিল। সকালের আলোতে সেই নরপশুকে দেখতে চন্দ্রার বড় ইচ্ছা করছিল। বেড়ার পলিথিন একটু বেশি করে ছিড়ে ফাঁকাটা একটু বড় করে বাইরে দেখতে চেষ্টা করল। লোকদের মুখগুলো এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। নিখিল যখন তার বাবার পায়ের কাছে পড়ল তখন চন্দ্রা বুঝতে পারলো যে এই সেই নরপশু। নিজের অজান্তেই চোখ দুটি দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। চারিদিক একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। ঘৃনায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করতে। তবুও ওদের কথাগুলি শুনতে চেষ্ট করছে ও।
জমিদার এবার সর্দারের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে সর্দার কি উত্তর দেয়। কারও কারও কাছে এটা উপরাল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছুই না। এতবড় মন জমিদারের? আবার কেউ কেউ ভাবছে, এটা জমিদারের একটা চাল। তার ছেলেকে বাঁচাবে আর নিজের সম্মানও বাড়াবে। দেখ যাবে কয়েকদিন পরে কোন দোষ দিয়ে বাড়ি থেকে বেড় করে দেবে তখন লোকেরা উল্টা চন্দ্রাকেই দোষী করবে। 
সর্দার মাথা তুললেন। বললেন, আমাকে একদিনের সময় দিন, আমার আত্মিয় স্বজনদের সাথে কথা বলে আমি কাল জানাবো। সর্দারের কথা শুনে লোকেরা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো। শেষে জমিদার বললেন, ঠিক আছে সর্দার তুমি কালই জানাবে, আমি আসি তাহলে। এই বলে জমিদার উঠে দাঁড়ালো আর সকলেই তার সঙ্গে দাঁড়ালো। জমিদার তার লোকজন নিয়ে ফিরে গেলেন। তার যাবার পথের দিকে বস্তির সকলে তাকিয়ে আছে। 
রাতে সর্দার তার ছেলেদের নিজের ঘরে ডাকলেন তার সাথে দলের কয়েকজন মুরব্বিকেও ডাকলেন। তিনি তাদের কাছে সকালের সমস্ত ঘটনা আর জমিদারের প্রস্তাব তুলে ধরলেন। আর তাদের পরামর্শ জানতে চাইলেন। প্রথমে সকলেই চুপ করে বসে থাকলো। তারপর ভাইয়েরা সকলে এক এক করে তাদের কথা বলতে শুরু করল। তীব্র রাগ আর ঘৃণা তাদের মুখে অকথ্য গালি হয়ে গড়িয়ে পরছিল। তারা মোটামুটি এটাই বুঝাতে চেয়েছে যে, তারা তাদের বোনকে কেঁটে নদীতে ভাঁসিয়ে দিতে রাজি আছে তবুও ঐ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি নয়। যে ছেলে একটা অসহায় মেয়ের সঙ্গে এই রকম করতে পারে সে কখনই মানুষ না। আর একটা অমানুষের সঙ্গে তারা তাদের বোনের বিয়ে দিতে রাজি নয়। একে একে বৃদ্ধরাও তাদের কথা বলতে শুরু করল। কেউ কেউ ভাইদের কথার সুরে সুর মেলাল আবার কেউ কেউ জমিদারের মহানুভবতা কথা বলছে। তর্কেবিতর্কে রাত গভীর হয়ে গেল। শেষে বড় ছেলে কাশেম বলল, আমরা মুসলমান আর আমাদের বোনকে কোন অমুসলিমের কাছে তুলে দিতে পারবো না। আর তারা যেহেতু প্রায়চিত্ত করতে রাজি আছে তাই জমিদার বাড়িতে থাকে এমন সকল পুরুষ যদি খৎনা করে তবে আমরা বুঝবো যে তারা সত্যি কথাই বলছে তাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য নাই। আর শুধু মাত্র এভাবেই আমরা আমাদের বোনকে নিখিলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি আছি। আর না হলে আমরা প্রয়োজনে এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব তবু ওর হাতে বোনকে দেবো না।
অনেক চেষ্টা করেও ছেলেদের মত বদলাতে পারলো না সর্দার। তাই এই সিদ্ধান্ত হল যে, কালকে সর্দার এবং বড় ছেলে কাশেম এবং কয়েকজন বয়ষ্কদের নিয়ে জমিদার বাড়ি যাবে আর এই প্রস্তাব দেবে। জমিদার যদি রাজি থাকে তাহলে এই কথা এগোবে আর যদি রাজি না হয় তবে ওরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবে। কথা শেষ করে সকলে যে যার মত ঘুমাতে ঘরে চলে গেল। 
পরের দিন সকালে কয়েকজন বৃদ্ধ বেদেদের নিয়ে সর্দার আর কাশেম জমিদারের বাড়িতে এসে হাজির হল। সকাল সকাল সর্দারকে দেখে জমিদার খুশিই হল। যদিও জমিদার তার মুখে হাসি ধরে রেখেই কথা বলছে। তবুও তীব্র একটা কষ্ট তাকে একটু একটু করে অসুস্থ করে তুলছে। সর্দার আর তার সাথের অথিতিদের বসতে বলে তিনি নিজই তাদের কাছে এসে বসলেন। বললেন, বলুন আপনাদের সিদ্ধান্ত কি? আপনারা কি আমাদের প্রস্তাবে রাজি আছেন?
জমিদারের কথা শুনে সকলে মাথা নিচু করে বসে রইলো, শেষে সর্দার মাথা তুলে জমিদারের দিকে তাকালেন। মুখে একটু হাসি রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু ভয় সেই চেষ্টাটুকুকে মলিন করে দিচ্ছে। বললেন, জমিদার বাবু, আমরা কাল রাতে অনেক সময় ধরে সমস্ত বিষয় গুলি নিয়ে কথা বলেছি। আমাদের কি বলা উচিৎ তা আমরা আলোচনা করেছি। আমরা ভেবেছি যে কি করলে আমাদের অভাগা মেয়েটির উপকার হবে। এতটুকু বলে সর্দার আবার তার মাথা নামিয়ে নিল। তখন জমিদার বললেন বেশ তো বলুন, আপনাদের সিদ্ধান্ত কি? আমাদের দিক থেকে আমরা সব কিছু করতে রাজি আছি। আপনারা যা চান আমরা তাই দেবো। বলুন, আপনাদের কি চাই? 
সর্দার আবার মাথা তুলে বলল, জমিদার বাবু, আমরা মুসলমান, তাই খৎনা করান হয় নাই এমন করো সঙ্গে আমাদের মেয়েকে আমরা বিয়ে দিতে পারবো না। আমরা আপনার টাকা পয়সা চাই না।
কথাটা শুনে জমিদারের মুখটা শুকিয়ে গেল, তার দিকে তাকিয়ে সর্দার বলল, তবে আপনারা যদি একটা কাজ করেন তবে আমরা আপনাদের প্রস্তাবে রাজি আছি। 
বলুন, কি কাজ করতে হবে? জমিদার আগ্রহের সঙ্গে সর্দারের আরও কাছে চলে আসলেন।
সর্দার বলল, জমিদার বাবু, আপনি ও আপনার বাড়ির সকল পুরুষ যদি খৎনা করেন তবেই আমরা আপনার কথায় রাজি আছি। আপনাদেরকে একটা প্রমাণ দিতে হবে যে আপনারা সত্যিই আমার মেয়েকে ভালবাসবেন। 
জমিদারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তার মুখ থেকে সমস্ত রক্ত যেন নিচে নেমে এলো, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জমিদার চিৎকার করে উঠলো, সর্দার, তোমার সাহসের একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। আমার দয়ালু মন কে আমরা দুর্বলতা ভেবো না। 
জমিদারের চিৎকারে ঘরের সকলে কেঁপে উঠলো। এমন সময় নিখিল দৌড়ে সবার মাঝখানে আসলো। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, তুমি তো আমাকে ভালবাসো, আমার জন্য তুমি সব কিছু করতে পারো। তুমি তো জীবন পর্যন্ত দিতে রাজি আছো, তবে বাবা তুমি আমার জীবন বাঁচাবে না? বাবা আমি যে অন্যায় করেছি তার প্রায়চিত্ত আমাকে করতে হবে। আমার জন্য এতটুকু কর। আমি তোমার পা ধরছি। বলেই নিখিল তার পিতার পায়ের উপরে গিয়ে পড়ল। 
জমিদার মাথা নিচু দাড়িয়ে রইল। জমিদার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কিছু সময় আদর করলো। তারপর ওকে সর্দারের কাছে নিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে সর্দার আমি আমার ছেলের জন্য সব কিছু করতে পারি। আপনারা খৎনার ব্যবস্থা করুন। 
জমিদারের এই কথা শুনে সেখানে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সর্দার বলল, ঠিক আছে, জমিদার বাবু আমি কালকেই ব্যবস্থা করছি আপনারা সকলে প্রস্তুত থাকবেন। 
এই বলে সর্দার তার সঙ্গের লোকদের নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। 
৪
পরের দিন সকালে সর্দার একজন ডাক্তার নিয়ে আসলো আর একে একে সকল পুরুষের খৎনা করাল। সেদিন সেখানে কমবেশ ২০ জনের খৎনা হলো। আর তাদের খৎনা করানোর তৃতীয় দিনে যখন জমিদার বাড়ির সকল পুরুষেরা কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ল তখন তাদের উপরে নেমে আসলো এক মহা দুর্যোগ। কেউ এতটুকুও অনুমান করতে পারে নি যে এই রকম হতে পারে। সেদিন রাতে সর্দারের বড় ছেলে কাশেমের নেতৃত্বে একদল বেদে রাতের আঁধারে জমিদার বাড়ি উপরে হামলা করে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে পুরুষেরা হামলার প্রতিরোধ করা চেষ্টা শুরু করতে করতেই  সব কিছু শেষ হয়ে গেল। একে একে লাশ পড়তে লাগলো। দুধের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউই বাঁচতে পারলো না। সবাইকে শেষ করে তারা পালিয়ে বস্তিতে চলে এলো আর সবাইকে ডেকে পালানোর জন্য প্রস্তুত হতে বলল। চারিদিকে চিৎকার আর দৌড়া দৌড়ির শব্দ শুনে সর্দার বাইরে বেড়িয়ে এলো। সে চিৎকার করে বার বার জানতে চাইছে কি হয়েছে কিন্তু কেউই তার সাথে কথা বলার জন্য সময় দিচ্ছে না। সবাই যার যার মালামাল নিয়ে নিজের নিজের নৌকার দিকে এগোচ্ছে। ঠেলা-ঠেলি করে সকলেই নৌকাতে গিয়ে উঠছে। কয়েকটি নৌকাতো এ মধ্যে ছেড়েও দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কে যেন সর্দার আর চন্দ্রাকে নৌকায় তুলল। সে শুধু ছেলেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে থাকলো, তোমরা আমাকে কেন বলছ না, কি হয়েছে? কেন আমরা পালিয়ে যাচ্ছি? হাল্কা আলোতে সর্দার বুঝতে পারলো যে তার ছেলেদের সারা গায়ে রক্ত মেখে আছে। কি করেছো তোমরা? তোমাদের গায়ে রক্ত কেন? আমাকে উত্তর দেও। 
কাশেম বলল, এখন চুপ থাক; নৌকাতে গিয়ে বলব। আগে চল। হঠাৎ করে বেদে বস্তিতে যেন একটা ঝড় বয়ে গেলো। সব কিছু ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। যে যা পেয়েছে তাই নিয়েই নিজেদের নৌকা ছেড়ে দিল। কয়েক সেকেন্ডেই ফাঁকা হয়ে গেল ভুতের ভিটা। আর নিজেদের নৌকা নিয়ে যে যত জোড়ে পারছে ছুটে চলছে। 
চারিদিকে সকালের আলো ফুঁটবে ফুঁটবে করছে। নদীর বুক চিরে কিছু নৌকা যেন পাল্লা দিয়েছে। ওদের ভাগ্যও ভাল কারণ স্রোতও ওদের অনুকুলেই বইছিল, তাতে নৌকার গতি এতই বেড়ে গিয়েছিল যেন মনে হচ্ছে নৌকাতে ইঞ্জিন লাগানো রয়েছে। ইতিমধ্যে সকালের আলো ভাল ভাবেই ফুঁটে উঠেছে। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। রাতে নৌকায় উঠেই চন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে ঘুম থেকে নদীর পানিতে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে শুনলো তার বড় ভাই আর বাবা কথা বলছে। সে শোনার জন্য একটু সরে এসে কান পাতলো।  
তোমরা কেন আমাকে বলছো না। কি হয়েছে? তোমরা কি করেছো? কালকে তোমাদের গায়ে রক্ত ছিল কেন?
আমরা জমিদারের পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছি। নিখিলকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছি। আমাদের বোনকে অপমান। এই এতটুকু বোনটিকে পশুর মত অত্যাচার করেছে। আবার জুতা মেরে গরু দান করতে এসেছে। কাশেমের চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হয়ে আসতে চাইছে।
সর্দার যেন থমকে গেল। কি বললে তোমরা এত বড় অন্যায় করেছো?
অন্যায়? 
অন্যায় নাতো কি?
ও যেটা করেছে সেটা অন্যায় নয়? এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি।
কথা গুলি শুনতে শুনতে চন্দ্রা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। সে বেহুশ হয়ে গেল।
কাশেম আবার চিৎকার করে বলল, আমরা ওকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারতাম না। 
ওরা ওদের ভুল বুঝতে পেরেছিল। আর তাইতো প্রায়চিত্ত করতে চেয়েছে। আমাদের সব শর্তে তারা রাজি হয়েছে। নিজেদের জাত খোয়ানোরও ভয় করেনি। 
ভুল বুঝতে পেরেছে? সব মিথ্যা, সব ভন্ডামি। শেষ করে দিয়েছি। রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছি জমিদার বাড়িতে। 
সর্দার নিজের মধ্যে শুকিয়ে গেল। নিজের হাটু মধ্যে নিজের মাথাটা লুকিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এ তোমরা কি করলে। আল্লাহ সহ্য করবে না। এ অন্যায়। এর হিসাব তোমাদের দিতে হবে।
হঠাৎই সর্দার নীরব হয়ে গেল। কেউ তার দিকে খেয়াল করলো না। কাশেম সমস্ত শক্তি দিয়ে নৌকা বেয়ে নিয়ে চলছে। এর কিছু সময় পরে চন্দ্রার হুশ ফিরলো। আর সে নৌকার সামনের গলইয়ের কাছে গিয়ে বসল। সে দেখেছে তার বাবা নৌকার একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে আর ভাইয়েরা সকলেই গোশল করে পরিষ্কার কাপড়- চোপর পড়ে নিয়েছে। কিন্তু এ কি? চারিদিকে বাতাসে শুধুই রক্তের গন্ধ। শুধুই রক্ত। পানির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো চন্দ্রা এ কি নদীর সব পানি লাল হয়ে গেছে। একটা একটা ভাবনা চন্দ্রার মাথায় এসে উঁকি মারছে। সেই নদীর পাড়, সেই গ্রাম। বাবার সঙ্গে সেই হাটে যাওয়া। তারপর হঠাৎই চন্দ্রার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসলো। সেই দুঃস্বপ্ন। সেই নরপশু, হায়নার শরীরে ও নিখিলের মুখটা দেখতে পেল। মুহুর্তে একটা রাগ, ঘৃণা একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করল। দোষী নিখিলের চেহারা, অপরাধী নিখিলের চেহারা। তারপর দেখলো বস্তিতে সর্দারের পায়ের কাছে পড়ে থাকা অনুতপ্ত নিখিলকে। বাইরে এসে ভালো ভাবে দেখার সাহস ছিল না চন্দ্রার তাই বেড়ার ফাঁক দিয়েই সেই মুখ ও দেখেছে। সব কিছু যেন আবার অন্ধকার হয়ে এলো। পদ্মার বুকে পানির স্রোতের সাথে তীরের গতিতে ছুটে চলছে ওদের নৌকা। আশে পাশে তার আরও ভাইদের এবং প্রতিবেশিদের নৌকাও রয়েছে। কিন্তু চন্দ্রা যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। বাতাসে শুধুই রক্তের ঘ্রান আর নদীতে যেন একটার পর একটা লাশ ভেসে চলছে। চন্দ্রা জানে যে ওরা পালাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তা জানে না। শুধুই জানে যেতে হবে। বহু দুরে পালিয়ে যেতে হবে।
আবার চারিদিকের ভাবনা ওর মাথায় আসতে থাকলো।
আচ্ছা সত্যিই কি নিখিল ওকে ভালবেসে ছিল? নিজের মনেই আবার নিজেই উত্তর দিতে লাগলো। 
না তা হতে পারে না। সেই হিস্রতা, বন্যতার মধ্যে ভালবাসা কোথায়? ও কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারে না। 
আচ্ছা সত্যিই কি ও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? কেন বিয়ে করতে চেয়েছিল? বেদেদের তো কোন কিছু করার ক্ষমতা ছিল না তবুও কেন ও পাপের প্রায়চিত্ত করতে চাইলো। যদি বিয়ে হত তবে চন্দ্রা কি পারতো সেই রাতের কথা ভুলে যেতে। নিখিলের চেহারা কি সেই রাতকে মনে করিয়ে দিত না? যে ভালবাসার আয়না নিখিল নিজেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে সেই আয়নায় কি ভাবে ও নিখিলের রুপ দেখতে পাবে। বড় অন্যায় করেছে নিখিল। কিন্তু সত্যি কি ভালবেসে ফেলেছিল? ও কি পারতো ওর ভালবাসা দিয়ে চন্দ্রার সেই দুঃস্বপ্নকে ভুলিয়ে দিতে। সেই রাতকে মুছে দিত। চন্দ্রা কি পারতো সেই ঘৃণাকে ভুলে নিখিলকে গ্রহন করতে। হৃদয়ের সিংহাসনে বসাতে। নিখিল কি পারতো চন্দ্রার ক্ষত-বিক্ষত মনটাকে সারিয়ে তুলতে? কিন্তু সেই সুযোগ তো সে পেলো না। তাকে দেয়া হলো না। হাজারো প্রশ্ন চন্দ্রার মনে খেলে যাচ্ছিল। চন্দ্রার চিন্তা যেন নৌকার চেয়েও দ্রুত চলছে। 
চন্দ্রা পিছনে ফিরে দেখলো কাশেম পাল তুলে দিয়েছে। আর নৌকা আরও দ্রুত এগিয়ে চলছে। কিন্তু আজ ভাইকে বড় অপরিচিত লাগছে। এই ভাই তাকে কোলে করে বড় করেছে। কিন্তু ও তাকে চিনতে পারছে না। রক্ত পিপাসু এক দানবের মত লাগছে। সত্যিই নিখিলকে একটা সুযোগ দেবার প্রয়োজন ছিল। ও যদি সত্যই ভাল না বাসতো তবে ভাইদের সমস্ত শর্ত ও মেনে নিতো না। মানুষতো পরিবর্তীত হয়। সে তার ভুল বুঝতে পারে। 
নিখিল তার জৈবিক তারনায় সেদিন যেটা করেছে সেটা যদি অন্যায় হয় তবে ও ভাইয়েরা যেটা করেছে সেটা কি? চন্দ্রা কাকে ক্ষমা করবে কাকে ঠিক বলবে? হঠাৎই চন্দ্রা নদীর জলে নিখিলের চেহারাটা দেখতে পায়। রক্তাক্ত মুখ অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর যেন বলছে, চন্দ্রা আমি সত্যিই তোমাকে ভালবেসে ছিলাম। আমি অন্যায় করেছিলাম, কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার একটা সুযোগ আমাকে দিল না ওরা। আমি তোমাকে সত্যিই ভালবেসে ছিলাম। চন্দ্রার দুচোখ দিয়ে অঝড়ে পানি ঝড়ে পরতে থাকলো। জলে নিখিলের ছবির দিকে তাকিয়ে চন্দ্রা বলে, নিখিল আমি বড় অসহায়। আমার কোন ক্ষমতা ছিল না তোমাকে ক্ষমা করার। তোমাকে একটা সুযোগ দেবার। তুমি আমার সঙ্গে যা করেছো তার জন্য তুমি দোষী কিন্তু আমার ভাইদের হিস্রতা তোমার অন্যায়কেও ছাড়িয়ে গেছে। তুমি আমার কাছে কেন ক্ষমা চাইছো আমিই তো তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো। কথাগুলি নিজের মনে মনে বলতে বলতে চন্দ্রা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। তীব্র একটা যন্ত্রণা ওর হৃদয়কে চিরে ফেলছে। আন মনেই বলে উঠলো, নিখিল আমাকে ক্ষমা কর। তোমার অপরাধের শাস্তি তুমি পেয়েছো কিন্তু আমার ভাইয়েরা যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি তাদের কে দেবে? আমি কিভাবে এই অপরাধীর জীবন বয়ে বেড়াবো? নিখিল আমি আসছি, আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। আর তোমার হাতে আমার জীবনকে সমর্পন করছি। এটাই তোমার অনুতপ্ততার প্রতি আমার সম্মান। 
হঠাৎ করেই জলের মধ্যে কিছু পড়ার একটা শব্দ হল। কাশেম সেই দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। সে আবার আপন মনে নৌকা চালাতে লাগলো। হঠাৎই খেয়াল হল গলুইয়ের ধারে চন্দ্রা বসে ছিল, সে বৈঠা ফেলে দৌড়ে গলুইয়ের কাছে আসলো। দেখলো চন্দ্রা নাই। নৌকার কোথাও চন্দ্রাকে দেখা গেল না। 
কাশেম চিৎকার দিয়ে বলল, বাবা, চন্দ্রা নাই ও নদীতে ঝাপ দিয়েছে। পদ্মার ঘোলা জলে চন্দ্রার কোন চিহ্ন দেখা গেলো না। কাশেম খেয়াল করল বাবাও কোন সাড়া দিচ্ছেনা। দৌড়ে বাবার কাছে আসলো সে। হাত দিয়ে বাবাকে একট নাড়া দিতেই সে নৌকার পাটাতনে লুটিয়ে পড়ল। কাশেক হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকলো। ভাইদের ডেকে বলতে লাগলো বাবা নাই, চন্দ্রা আমাদের ছেড়ে চলে গেয়ে। তার চিৎকারে আকাশ বাতাস এক হয়ে যেতে লাগলো। 
বাতাসে যেন একটি কথাই ভেসে বেড়াতে লাগলো,
ভাইজান, আমি তোমাদের পাপের প্রায়চিত্ত করে গেলাম।            
            
1489 বার পড়া হয়েছে
শেয়ার করুন
জয় নোটন বাড়ৈ

জন্ম আর বেড়ে ওঠা খুলনাতে। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহীত আর দুই সন্তানের পিতা। একমাত্র স্ত্রী, পারিবারীক জীবনে অতন্ত সুখী। পেশাগত জীবনে খ্রীষ্টিয়ান ধর্মতত্ব কলেজে অধ্যাপনা করি। এখন নিজ বাড়ী খুলনাতে থাকি আর লেখালেখি নিয়েই রয়েছি। ছোট গল্প আমার অসম্ভব ভাল লাগার বিষয়।

8 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.