রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার, নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার। রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা, করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা। শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে, তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে। ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান, এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ? ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু, শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু। ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে, ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?” মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ” ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?” পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত, পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ। নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান, ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ। ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর। কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর। বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি, বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি। চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি, দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি। যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে, বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে। ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল, করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল? আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?” মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে, ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে। “শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে, রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে। খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে, ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।” ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত, বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত। রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে, কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে। সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ, হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান। এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে, ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে? কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার, ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার। আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই, বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই। করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা; উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা। আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা, ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা। ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর, মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর। পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি, কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি। ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে, ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে। রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা। সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা। পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা, আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।
জসীমউদ্দীন
জসীমউদ্দীন (জানুয়ারি ১, ১৯০৩ - মার্চ ১৩, ১৯৭৬) পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে পল্লী কবি হিসেবে পরিচিত। তার লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবদান। তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়। (উৎসঃ উইকিপিডিয়া)
জসীমউদ্দীন এর সর্বশেষ লেখা
2 মন্তব্য
- মন্তব্যের লিঙ্ক মঙ্গলবার, 17 অক্টোবর 2023 04:02 লিখেছেন expalay
buy cialis 10mg 81 were associated with sexual discomfort
- মন্তব্যের লিঙ্ক বৃহষ্পতিবার, 13 জুলাই 2023 16:36 লিখেছেন YnlxXV
generic name for cialis In 1 500 cases, the inflammation progresses despite treatment to Stage 3 denser aggregation of white cells in the visual axis with clearing in the periphery
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.