চলে মুসাফির গাহি, এ জীবনে তার ব্যথা আছে শুধু, ব্যথার দোসর নাহি। নয়ন ভরিয়া আছে আঁখিজল, কেহ নাই মুছাবার, হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেহ নাই শুনিবার। চলে মুসাফির নির্জন পথে, দুপুরের উঁচু বেলা, মাথার উপরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া করিছে আগুন-খেলা। দুধারে উধাও বৈশাখ-মাঠ রৌদ্রেরে বুকে চাপি, ফাটলে ফাটলে চৌচির হয়ে করিতেছে দাপাদাপি। নাচে উলঙ্গ দমকা বাতাস ধুলার বসন ছিঁড়ে, ফুঁদিয়ে ফুঁদিয়ে আগুন জ্বালায় মাঠের ঢেলারে ঘিরে। দুর পানে চাহি হাঁকে মুসাফির, আয়, আয়, আয়, আয়, কস্পন জাগে খর দুপুরের আগুনের হলকায়। তারি তালে তালে দুলে দুলে উঠে দুধারের স্তব্ধতা, হেলে নীলাকাশ দিগনে- বেড়ি বাঁকা বনরেখা-লতা। চলে মুসাফির দুর দুরাশার জনহীন পথ পাড়ি, বুকে করাঘাত হানিয়া সে যেন কি ব্যথা দেখাবে ফাড়ি। নামে দিগনে- দুপুরের বেলা, আসে এলোকেশী রাতি, গলায় তাহার শত তারকার মুন্ডমালার বাতি। মেঘের খাঁড়ায় রবিরে বনিয়া নাচে সে ভয়ঙ্করী, দুর পশ্চিমে নিহত দিনের ছিন্নমুন্ড ধরি। রুধির লেখায় দিগন্ত বায় লোল সে রসনা মেলি, হাসে দিগনে- মত্ত ডাকিনী করিয়া রক্ত-কেলি। চলেছে পথিক-চলেছে সে তার ভয়ঙ্করের পথে, বেদনা তাহার সাথে সাথে চলে সুরের ইন্দ্ররথে। ঘরে ঘরে জ্বলে সন্ধ্যার দীপ, মন্দিরে বাজে শাঁখ, গাঁয়ের ভগ্ন মসজিদে বসি ডাকে দুটো দাঁড়কাক। কবরে বসিয়া মাথা কুটে কাঁদে কার বিরহিনী মাতা, চলেছে পথিক আপনার মনে বকিয়া বকিয়া যা-তা। চলেছে পথিক-চলেছে পথিক-কতদুর-কতদুর, আর কতদুর গেলে পরে সে যে পাবে দেখা বন্ধুর। কেউ কি তাহার আশাপথ চাহি গণেছে বয়ষ মাস, ধুঁয়ার ছলায় কাঁদিয়া কি কেউ ভিজায়েছে বেশবাস? কিউ কি তাহারে দেখায়েছে দীপ কানো গেঁয়ো ঘর হতে, মাথার কেশেতে পাঠায়েছে লেখা গংকিণী নদী সোঁতে? চলেছে পথিক চলেছে সে তার ললাটের লেখা পড়ি, সীমালেখাহীন পথ-মায়াবীর অঞ্চলখানি ধরি। ঘরে ঘরে ওঠে মৃদু কোলাহল, বঁধুরা বধুর গলে, বাহুর লতায় বাহুরে বাঁধিয়া প্রণয়-দোলায় দোলে। বাঁশী বাজে দুরে সুখ-রজনীর মদিরা-সুবাস ঢালি, দীঘির মুকুরে হেরে মুখ রাত চাঁদের প্রদীপ জ্বালি। নতুন বধুর বক্ষে জড়ায়ে কচি শিশু বাহু তুলি, হাসিয়া হাসিয়া ছড়াইছে যেন মণি-মানিকের ধুলি। চলেছে পথিক-রহিয়া রহিয়া করিছে আর্তনাদ- ও যেন ধরার সকল সুখের জীবন- প্রতিবাদ। রে পথিক ! বল, কারে তুই চাস, যে তোরে এমন করে, কাঁদাইল হায়, কেমন করিয়া রহিল সে আজ ঘরে? কোন ছায়া-পথ নীহারিকা পারে, দেখেছিলি তুই কারে, কোন সে কথার মানিক পাইয়া বিকাইলি আপনারে । কার গেহ ছায়ে শুনেছিলি তুই চুড়ির রিণিকি-ঝিনি, কে তোর ঘাটেতে এসেছিল ঘট বুড়াইতে একাকিনী । চলে মুসাফির আপনার রাহে কোন দিকে নাহি চায়, দুর বনপথে থাকিয়া থাকিয়া রাত-জাগা পাখি গায়। গগনের পথে চাঁদেরে বেড়িয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা, সে মৌন চাঁদ আজো হাসিতেছে, বলিল না, উহু আহা। বউ কথা কও-বউ কথা কও-কতকাল -কতকাল, রে উদাস, বল আর কতকাল পাতিবি সুরের জাল। সে নিঠুর আজো কহিল না কথা, রহস্য-যবনিকা খুলিয়া আজিও পরাল না কারো ললাটে প্রণয় টীকা। চলেছে পথিক চলেছে সে তার দুর দুরাশার পারে, কোনো পথবাঁকে পিছু ডাকে আজ ফিরাল না কেউ তারে। চলেছে পথিক চলেছে সে যেন মৃত্যুর মত ধীরে, যেন জীবন- হাহাকার আজি কাঁদিছে তাহার ঘিরে। চারিদিক হতে গ্রাসিয়াছে তারে নিদারুণ আন্ধার, স্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধেছে ক্রন্দন শুনি তার।
জসীমউদ্দীন
জসীমউদ্দীন (জানুয়ারি ১, ১৯০৩ - মার্চ ১৩, ১৯৭৬) পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে পল্লী কবি হিসেবে পরিচিত। তার লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবদান। তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়। (উৎসঃ উইকিপিডিয়া)
জসীমউদ্দীন এর সর্বশেষ লেখা
1 মন্তব্য
- মন্তব্যের লিঙ্ক বুধবার, 19 জুলাই 2023 04:18 লিখেছেন TXBJnPA
buy cialis online prescription 3, respectively, of the total hormone concentration Benvenga, 2005
মন্তব্য করুন
Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.