বৃহষ্পতিবার, 13 জুলাই 2017 00:43

অনুকরণ-অনুসরণ

লিখেছেন
লেখায় ভোট দিন
(1 ভোট)
                অনুকরণ-অনুসরণ
 - মণি জুয়েল(Moni Jewel) 

মাঝে মাঝে ভাবি- আমার পরবর্তী প্রজন্ম আমার কাছ থেকে কি পাবে, আমি আগামীর জন্য কি করে যাচ্ছি, আদৌ কিছু করতে পারছি কি! অনেকক্ষণ ভেবে স্থির করি- পারি বা না পারি, চেষ্টা তো করছি আন্তরিকতার সাথে, ভালোবেসে, বোধ ও বুদ্ধি মিশিয়ে, আবেগে প্লাবিত হয়ে।
 সাথে সাথে এও ভাবনা আসে- আমাকে তো কেউই বিশেষ কিছু দিয়ে যায় নি, যা কিছু আজ আমি হাসিল করেছি। বলা যেতে পারে আমি খুঁজে নিয়েছি । কথাটা কিন্তু বড় ভুল বোঝার মতোই। 
যাইহোক, সাধারণত কেউই কাউকে কিছু দেয় না, আমাদের আহরণ করে নিতে হয়। কিন্তু সংগ্রহ করি কোথা থেকে? যা কিছু সংগ্রহ করে আমরা সমৃদ্ধ, তা তো কেউ না কেউ দান করেই গেছেন। দেওয়াটা সবসময় যে তালুর বদল তা নয়, আবার এও বলা যেতে পারে- কিছুই নেই এমন কিছু থেকে পাওয়া হয়ে যায়। শুণ্যতা'ই পুর্ণতার কারণ। শূন্যতা এবং পূর্ণতা এই দুই একসাথে জড়িত। যেমন একটি চুম্বকের দুই মেরু। দুই মেরু না থাকলে চুম্বক বলা যায় কি? ঠিক চুম্বকই আমরা। 
আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় গ্রহণ করে সবই, যা দরকারি তাও, আর তখনকার মতো অদরকারী তাও। যা আমরা শিখেছি বলি দাবি করছি তা কারো বা কারোদের দানই বটে। কিন্তু তা আমরা প্রয়োগ করি তখন, আমাদের নিজের ভেতরের সাড়া মেলে যখন। 
কিন্তু ঘটনার প্রবাহে, ঘাতে প্রতিঘাতে আমি যা আহরণ করলাম, শিখলাম; শুধু তা-ই যদি শব্দের বদলে/ঢঙের বদলে শেখাতে চাই শেখাই তাহলে শিক্ষাণবিশের কাছে নতুন শিক্ষা হলেও তা কি নতুন আদৌ! আমি না শেখালেও কারো না কারো দ্বারা বা কারো না কারো মারফত, কোনো না কোনোভাবে শিখতো'ই দরকারে।
তাহলে তো ব্যপারটা গিয়ে দাঁড়ালো যা ভাগে পেয়েছি তাই দিয়েছি'র মতো। তাহলে আমরা কি দিলাম?
কয়দিন আগে কথা হচ্ছিলো বাংলাদেশের আমার মতো বয়সেরই এক কবির সাথে। অনুসরণ অনুকরণ বিষয় নিয়ে। সাধারণ সহজে বলেছিলাম- সাধারণভাবে বললে আমি অনুকরণের পথে চলি না, অনুসরণেও না বলা যেতে পারে। পরে ব্যক্তিগত বক্সে কথা হলে প্রশ্নের উত্তরে বলি- এ বিষয়ে আমার একটা মত আছে"। হয়তো আরো অনেকে আমার মতোই মনে করতে পারেন। এখানে এই আলোচনায় তা বলার চেষ্টা করছি। 
আমি অনুসরণ শুধু নয় হুবহু অনুকরণ করতেও রাজি, যদি সে থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নতুনদের জন্য। এখন সারা পৃথিবীতেই প্রায়; মুসলমানদের চিন্তাগত সংস্কৃতিগত যে দুরাবস্থা চলছে তার উন্নয়নের জন্য আমাকে যদি কোনো গুহায় গিয়ে বসে থেকে ধ্যাণ করে কোরাণের মতো সফল ক্রিয়াশীল নতুন কিছু হাসিল করা যায়, তার জন্য অনুকরণও করতে পারি। শুধুমাত্র সাধনার ধরণের অনুকরণ নয়, কোনো পোশাক কেমন ভাবে পরেছিলেন, হাতে পায়ে কি ছিলো, কি কি ভাবছিলেন, কি খেতেন কি খেতেন না, কি করতেন কি করতেন সব খবর নিয়ে অনুকরণ করতেই পারি। দরকারে চল্লিশোর্ধ মহিলার সাথে বিয়েও করতে পারি। আরো অনেকে পারেন। কিন্তু এ অনুকরণে যেহেতু নতুন কিছু নেই তাই নতুন কিছু সৃষ্টির সম্ভাবনাও নেই। সময়ের বদলে আজ সব প্রযোজ্যও হবে তাও স্বাভাবিক না। অথবা যদি মনে করা বলা হয় রবি ঠাকুর, কাজী কবি যেমন ধরণে লিখে গেছেন সে ধরণটা নেবো ভাবনা নিজস্ব, কথা নিজস্ব, বার্তা নিজস্ব। বড় চুল দাঁড়ি গোঁফ বা বড়চুল রাখবো না, আলখাল্লা পরবো না, যে ভাবে তাকাতেন সেভাবে না তাকিয়ে নিজের মতো করে তাকাবো। অনুকরণ তো একে বলা যাবে না। এ ধরণের ধারণ থাকলে আর যাই হই বা হউন আবিষ্কর্তা সহজে হতে পারবো না। লুই পাস্তুরের জলাতঙ্কের সুত্র দিয়ে জলাতঙ্কেরই টীকা আবিষ্কার হবে, অন্য কিছুর নয়। আবার পুরোনো কিছুর সাথে নতুন মিশিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করতেও নতুনই হওয়া লাগে, কারণ মিশ্রণের সে ধারণাটা নতুন এবং যা ফল হবে তাও নতুন হয়। নতুন না হলে নতুন কিছু আনয়ন সম্ভব না, নতুন ধরণের কিছু সৃষ্টি সম্ভব না । যখনই কেউ নতুনের জন্য এগোবেন তার সে বিষয়ের সবকিছু নতুন হয়েই যায় আপনাআপনিই, স্বাভাবিকভাবে। আমাদের দেশের গান্ধীজি হিন্দুত্বে নতুন রঙীন কভার লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার। এর দ্বারা তিনি কিছুটা সমতা আনার চেষ্টা করেছিলেন, এ জন্য  শ্রদ্ধা জানাতেই পারি। কিন্তু যা ঠিক নয় তা তো ঠিক নয়ই। ত্যাগ করলে পুরো ত্যাগ করতে হয়, গ্রহণ করলে পুরো গ্রহন। কিছুকে আঁকড়ে ধরে থেকে নতুন ফল পাওয়ার আশা করা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কিছুদিন টিকলেও মুলস্রোতে তা হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। হয়তো বেঁচে থাকে বিশেষ বিশেষ কিছু কথা। এ-ই সাধারণ সত্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য ।
আজ যখন আমি এ লেখা লিখছি তার দুইতিনদিন আগেও বর্তমান পত্রিকায় পড়লাম সেই পুরোনো এক সমস্যা আজও বর্তমান। এখানে বঞ্চিতদের এমন ভাবনা দেওয়া খুব দরকার ছিলো- যে দেব দেবীরা তোমাদের দলিত করে, ছোট জাত করে, হরিজন করে(তাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী)রেখেছে তাদেরই পুজো করতে তোমাদের মন্দিরে যাওয়ার কি দরকার। এতো বড় পৃথিবী পড়ে থাকতে যারা মন্দিরে লুকিয়ে থাকে ব্রাক্ষ্মনদের আড়ালে তাদের তোমরা পুজো করবে কেন? যারা তোমাদের অধিকার কেড়ে রেখেছে, মানে ব্রাক্ষ্মণদের বিরুদ্ধে যে দেবতাদের কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেই তারা তোমাদের দেবতা হতে পারে মুক্তি দাতা হতে পারে এ ধারণা মুছে ফেলো। মন্দিরের ভাবনাটাই মুছে ফেলো। সারা পৃথিবীর মুক্ততায় খোঁজো, যদি দেবতারা অসীম তবে সীমায় না খুঁজে অসীমে খোঁজো। যদি ঈশ্বর সবাতেই থাকেন তবে তোমাতেও আছে, তুমি তোমাকে ভালোবাসো। নিজে সুখী হলে সে সুখী। তা না করে সেদিন থেকে আজও আন্দোলন চলে আসছে সেই পুরোনো প্রলাপের, মন্দিরে প্রবেশাধিকার দিতে হবে'। আর বর্তামান বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে খবরের কাগজে চোখ বুলালেই দেখতে পাওয়া যায় উগ্র হিন্দুত্ব বনাম দলিত-মুসলমান-মানবতার লড়ায়। এমনকি গান্ধীজীর মৃত্যুও এমনই কিছু দ্বন্দ্বের কারণে বলে প্রচারিত(?)(প্রসঙ্গ এলে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে) ।সুতরাং অনুকরণের দ্বারা বা অনুকরণের আবরণ পাল্টে আমরা সমাজকে নতুন কিছু দিতে পারি না। পারি বলতে শুধু মাত্র উপরে উল্লেখিত ভাগে যা পেয়েছি তাই দিয়ে দিয়েছির মতো কিছু। ফল তেমন কিছুই মেলে না। যেটুকু সময়ের বদলই বদলে দেয় যা। 
এবার আসি অনুসরণ প্রসঙ্গে। অনুসরণ কথাটা যার তার মুখে শুনতেই পাই, কিন্তু অনুসরণ যে আসলে কেমন কি তা কেউ সেভাবে বলেন না, আমি শুনি নি, পড়ি নি। আমি মনে করি কারো বা কিছুর অনুসরণকারী তিনিই হতে পারেন যাঁর স্থান কাল পাত্র বোধ আছে এবং অনুশীলনকারী, অনুসন্ধানী, আবিষ্কার প্রবণতা যাঁর আছে। 
যেহেতু আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি তাই একটু কবিতা বিষয়ে বলি। ধরা যাক কেউ বিদ্রোহের কবিতা লিখবেন। বাংলা ভাষায় বিদ্রোহ কথাটা এলেই কাজী কবির নাম চলে আসে, আসাটা খুব উচিতও। এখন অনেকেই বিদ্রোহের কবিতা লেখার চেষ্টা করতে গিয়ে কাজী কবিকে আঁকড়ে ধরেন মানে অনুসরণ করে পার পেতে চান। ভাবা দরকার প্রথমে কবি ব্যক্তিটাকে নিয়ে, তারপর তাঁর সময়কাল নিয়ে, সে সময়ের সমস্যা নিয়ে, কবির অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে। ভেবে দেখি তো- আমাদের কারো কি মিলছে বিদ্রোহী কবি কাজীর কোনো কিছুর সাথে? সাধারণভাবে বলা যায় মিলবে না। সুতরাং তার স্থান শুধু তারই, আর অন্যের জন্য সে দ্বার কোনোদিনই খেলা ছিলো না সো আজও বন্ধ। প্রথমত আমরা কেউই সে ব্যক্তিটা নই, অবস্থা অবস্থান সময় কাল সবই আলাদা। তবে কি অনুসরণও করবো না? হ্যাঁ অবশ্যই করবো। কি করবো তা ভাবতে হবে। আগে নিজেকে এই পাঠ দিতে হবে পৃথিবীর বিখ্যাত যাঁরা তাঁরা তাদের কাজ তাঁদের মতো করে গেছেন, সবাই একক। যদি একক না হতেন তাহলে বিখ্যাত হতেন না। কেউই কারো ফটোকপি নন, সবাই আপন আপন সৌন্দয্যে বিরাজমান। সুতারাং অনুসন্ধান করি তাঁদের সেই অংশ, গুন যা তাঁদের ছিলো বলে তাঁরা বিশেষ। এবং অনুসরণ বা অনুকরণই করি ঠিক এটাই যে, আমরাও আমাদের নিজস্বতা স্বকিয়তা দিয়ে যতটা যা করার তা আন্তরিকতার সাথে করে যাবো। আগে ভাবতে শিখতে হবে- আমি নতুন, সুতরাং আমাকে সৃষ্টি করতে হবে নতুন। যা তারা করে গেছেন। মনে করে দেখুন তো রবি ঠাকুরের স্টাইলে অনেকেই লিখেছিলেন অনেক কিছু তাঁদের কয়জন কে কয়জন আমরা মনে রেখেছি। বা কাজী কবিকে যারা অকবি বলতো তাদেরই কয়জনকে জ্বলজ্বল করে ভোরের আকাশে জ্বলতে দেখি? কবি জীবননান্দ দাশ কি প্রতিষ্ঠা পেতেন তার নিজস্বতা না থাকলে? যদিও সমকালে তেমন মর্যাদা পান নি। অনুসরণ করার বিষয়টা হলো নিজস্বতা, স্বকিয়তা, নতুনত্ব। যা অনুকরণ করলেও ফলাফল সমান। 
কেউ চেষ্টা করতেই পারেন মহম্মদের ধরণে সাধনা করে কিছু অর্জন করার তা অনুকরণ এবং অনুসরণ দোষের না। কিন্তু কোরাণের মতো করতে চাওয়াটা দোষেরই বা সমালোচনার। কারণ যেখানে স্বকিয়তা থাকবে না। কেউ গৌতমবুদ্ধের মতো পথ অনুকরণ বা অনুসরণ করতেই পারেন নতুন কিছু হাসিল করতে। কিন্তু সাফল্যের পথে যেতে যেতে একক হয়েই যাবেন । মিলবে শুধু সৃষ্টির প্রবণতাটুকু। অনুসরণ করার বিষয় হলো- ঘাত প্রতিঘাত সয়ে, দরকারে জীবন বাজী রেখে নতুন কিছু আবিষ্কার। এই যদি অনুসরণ করা হয় তবে অনুকরণ করলেও দোষের কিছু নয়, নতুনত্বের জন্য অনুকরণ করাও যা অনুসরণ করাও তা। ভেবে দেখা যেতে পারে বাকী যা কিছু অনুসরণ মানেও অনুকরণ, সৃষ্টিতে যা মোটেও শোভনীয় নয়। কারণ সৃষ্টি বলা হয় তাকেই যা নতুন। আরো একটা বিষয় মনে রাখা দরকার নতুন কিছুর সহজগ্রাহ্যতা খুব কম। তবুও নতুন কিছুই আবিষ্কার করতে হবে, যদি আমার শুভ কিছুর তথাকথিত অনুসারী হতে চাই। মনে রাখতে হবে আজ যা প্রতিষ্ঠিত, যে সবে আমরা সমৃদ্ধ, সেগুলো সৃষ্টির সময়ে সাথে সাথে গ্রাহ্যতা পায় নি। অতীতের স্রষ্টাদের পরবর্তীপ্রজন্ম আমরা তা ভোগ এবং উপভোগ করছি। কিন্তু স্রষ্টারা সবাই একাগ্রতার সাথে, ভালোবেসে, সব কিছুকে একপাশে রেখে নতুন কিছু ধরণের বা আবিষ্কারের পথে এগিয়ে গেছেন। তেমনই আমাদেরও নতুন কিছু আবিষ্কার করে দিয়ে যেতে হবে, নতুন শৈলীর জন্ম দিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে পরবর্তী প্রজন্ম যেন আমাদের কাছে থেকে নতুন কিছু অল্প হলেও যেন পায়। আমাদের এই চেষ্টার অনুকরণ যেন তারাও করে, যেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন কিছু দিয়ে যেতে পারে। তাদের চিন্তায় এই বীজটা বপন করাটা আবশ্যিক।

*******ধুলিয়ান-01:00এএম-12.07.2017*******            
            
738 বার পড়া হয়েছে
শেয়ার করুন
মণি জুয়েল

মণি জুয়েল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ান নিকটস্থ বাবুপুর গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মপ্রহন করেন | তিনি একজন ভারতীয় বাঙালী। ২০০৪ সালে সাহেব নগর হাইস্কুল (এইচ. এস) থেকে মাধ্যমিক এবং ২০০৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। মালদা জেলায় অবস্থিত গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশুনো শেষ করেছেন ২০১১ সালে |ছাত্র অবস্থা থেকেই  শিক্ষা প্রসার, এবং বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ণ প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে আসছেন ...এই সামাজিক আন্দোলনের পথ ধরেই তিনি সমাজ বিকাশ কল্পে কলম ধরে বর্তমানে সমাজ সচেতনামূলক লেখালেখি করে থাকেন। এবার বাংলাদেশের বই মেলায় তার লেখা সামজিক মূল্যবোধক কবিতা "কবিদের নীল পদ্মে" ছাপা হয়েছে।সাথে সাথে অনান্য আরো লেখা 'একমুঠো আলো' কাব্যগ্রন্থ এবং অন্বেষা নামক ম্যাগাজিনে এই কবির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে |

মন্তব্য করুন

Make sure you enter all the required information, indicated by an asterisk (*). HTML code is not allowed.